blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ১৮


‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে ...’

লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে মিয়াভাই এবং দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত নাড়ছেন। লঞ্চ একটু একটু করে বানিয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লঞ্চ যান্ত্রিক চিৎকারে বিকেলের বাতাস ভারী করে তুললোএকরাশ কালো ধোঁয়া আকাশের দিকে ছুটে গেলোআকাশ ছুঁতে ব্যর্থ হয়ে সেই ধোঁয়া মনের দুঃখে বাতাসে বিলীন হয়ে গেলো। ঘাটে দাঁড়িয়ে রহিম আমি দুজনেই হাত নাড়ছি। রহিম মর্জিনার সাবান দিয়ে কেচে দেয়া লাল শার্টটি পরে এসেছে। তার মুখে উপচে পড়া হাসি। আমার হাত খানাই শুধু নড়ছে। মুখে বিষাদের ছায়া নাকি কালো ধোঁয়ার আভা! বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে। আমার মুখের হাসিটুকু কি চলে যাচ্ছে এই লঞ্চে করে ?

কয়েকদিনের ব্যস্ত সময়ে আমি অনেক কিছু ভূলে ছিলামপড়ালেখা মাথায় উঠেছেমায়ের বকুনি শুনে সন্ধ্যার কিছু পরে নিজের ঘরে পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে! রহিম আমার ঘরের ওপাশের চৌকি খাঁটে ঘুমায়। সে দোকানে গেছে কেরোসিন তেল কিনতে। গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসে নাইকয়রা থানা সদরে অবশ্য বিদ্যুৎ আছে। আমি প্রথম বিজলি বাতির আলো দেখি কয়রা থানা সদরে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। এখনো মধ্য যুগের মত ‘কিরাসিন’ এর কুপি বাতিই আমাদের ভরসা। কেরোসিনের বাতিকে আমরা বলি ‘টেমি’

দরজায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে আমি ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলামদ্বীপ্ত ভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। মিয়াভাই ফিরে আসার পর আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। মিয়াভাই যেন মুল ভিলেন। সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে কেন থাকতে হবে! কিন্তু আমার ঘরে কে নক করে আসবে ! সবাই এসে দড়াম করে দরজা খোলে। ছোট হওয়ার এই এক জ্বালা । প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকে না। আমি বললাম, কে ?
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, ‘আমি দ্বীপ্ত’

‘ভেতরে আসছেন না কেন ভাইয়া? ভেতরে আসেন’

আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি এরই মধ্যে দ্বীপ্ত ভাইয়া রুমে ঢুকে ভেজানো দরজা আবার ভিজিয়ে দিয়ে দরজার কপাটে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ালেন। নি:শব্দে আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেনতার চোখের চাহনি আমাকে বাঁধনহারা করে ফেললো। আমি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের তৃষ্ণার্ত অধরে প্রেমের সুধাবারি বর্ষিত হতে থাকলোদ্বীপ্ত ভাইয়া ভেতরে ভেতরে আমাকে এতটা মিস করেছে, ফিল করছে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাহিরে তিনি সব সময় সবার সাথে সহজ সরল প্রাঞ্জল ব্যবহার করছেন

দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখের মনি কাঁপছে।

‘কি হয়েছে জান?

‘এত দ্রুত সময় ফুরিয়ে গেলো শুভ্র! আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি’

আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া যে বেড়াতে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে এই কথাই তো আমি ভুলে গেছিলাম। আমি তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,

‘এত দ্রুত যাবে কেন ? আমি যেতে দিলে তো! কাল তোমাকে কিছুতেই যেতে দেবো না।’

‘আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ না হোক কাল যেতেই হবে। তাছাড়া সজলই তাড়াহুড়া করছে’

আমি আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না। দুচোখ কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে এলো। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার বুকে মাথা রাখলাম। শব্দ করে কাঁদতে পারছি না। চাঁপা কান্নার উচ্ছ্বাসে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি।  আমার মাথায় কয়েক ফোঁটা গরম জল ঝরে পড়লো। আমি মুখ তুলে দেখি দ্বীপ্ত ভাইয়াও নিরবে চোখের জল ফেলছেন। তার হাতের আঙুলগুলো আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমিও একই ভাবে তার চোখের পানি মুছে দিলাম। তার ঠোঁট নেমে এলো আমার ঠোঁটে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের আগে হয়তো এটাই আমাদের শেষ চুমু।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটে সেই আকাশী নীল শার্ট। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললো, ‘শুভ্র বাবু, তুমি আমাকে কি দেবে?

কি দেবো ! আমি দেওয়ার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঘরের চারদিকে তাকাই। কি দিবো আমি!

‘তোমাকে দেওয়ার মত কি আছে আমার? কি দেবো আমি!’

‘শুভ্র, তুমি আমাকে আমার জীবনের সেরা কিছু মুহুর্ত দিয়েছ। আমার খুব ইচ্ছে করে আমার ভালোবাসার কথা চিৎকার করে জানিয়ে দেইপুব বিলের মাঝে, শালিক খালির নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি স্মৃতি হিসেবে তোমার ব্যবহার করা এই গামছাটা নিয়ে যাবো। দেবে আমাকে?

‘তুমি আমাকে সাথে নাও। আমি ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবো । আর শুধু গামছা কেন, আমার সব কিছুই তোমার সব কিছু নাও তুমি’

‘পাগল ছেলে একটা’

তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রহিমের গলার স্বর শুনে হাত সরিয়ে নিলেন। শব্দ করে রহিম দরজা খুললো।  

‘খবর শুনিছো ছোড ভাই?’

‘কিসের খবর?’

‘ম্যাভাই কাইলকে চলে যাবে। আমাগে তো আগোয় দিতি যাতি হবে। তাড়াতাড়ি করে খায়ে শুয়ে পত্তি হবে’

‘তুই আছিস তোর শোয়া নিয়ে। যাবে তো বিকেলের লঞ্চে। তাতে তোর এখনি ঘুমানো লাগবে!’

‘ওহ। বৈকালে যাবে। আমি ভাবলাম বিহানবেলার লঞ্চে করে যাবে’।

রহিম বকা খেয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার সময় দরজা হাট করে খুলে রেখে গেছে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে আছি। মিনিট পাঁচেক বাদে খোলা দরজায় মিয়াভাইয়ের মুখ দেখা গেলো। আমার বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লেন।

‘শুভ্র, পড়াশোনা করছিস তো। দ্বীপ্ত’র কাছ থেকে অংক দেখিয়ে নিলে পারতি। অংকে দ্বীপ্ত সবসময় ৯৫% করে মার্ক পেয়ে এসেছে’


গার্জেনদের এই এক সমস্যা। বাড়িতে  লেখাপড়া জানা কেউ এলে বলে অমুকের কাছ থেকে অংক-ইংরেজি দেখে নে।


-----------------------------------------------------------------