blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ০৯

দিন দুই পরের ঘটনা। বেলা এগারোটা বাজে। রোদের তেজ হালকা। খুব একটা গায়ে লাগছে না। আমরা চারজন নেমে পড়েছি পাথরখালির খালে। মৃতপ্রায় খাল। জায়গায় জায়গায় প্রায় ভরাট হয়ে এসেছে। মাঝখানে কোমর পানি হবে। বেশীর ভাগ জায়গায় হাটু পানি। ভাইয়া তার ফ্রেন্ডকে বলে এসেছে গ্রামে তাকে নিজের হাতে তেলওয়ালা কই মাছ ধরে খাওয়াবে। সেই উক্তিকে সত্যে বাস্তবায়ন করার জন্যই এই খালে আসা। খালের বুক জুড়ে ফুটে রয়েছে অজস্র শাপলা। সাদা শাপলা, নীলচে সাদা শাপলা। চেউচির বন। এখানে জাল দিয়ে মাছ ধরে সুবিধা করা যাবে না। এটা রহিম আগেও বলেছিলো। কিন্তু মিয়াভাই পাত্তা দেয় নাই রহিমের কথা। ইয়া বড় খ্যাওলা জাল কাঁধে করে আনাই বৃথা হয়েছে। জাল খানা বিলের পাশে রেখে আমরা নেমে গেলাম খালের হাটু পানিতে। চেউচির, শাপলার গোঁড়ায় হাতড়াতে শুরু করলাম। হাতড়ে মাছ ধরার অন্য রকম আনন্দ আছে।

একসময় মিয়াভাই খুব মাছ ধরতে পারত। ভাই যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন আমি বড়ওয়ানে পড়লেও আমার বেশ মনে আছে। মিয়াভাই ডুব মেরে পুকুরের নিচের গর্ত থেকে মাছ ধরে আনত। সেবার সে ডুব মেরে এক গর্তে হাত ঢুকিয়েছে। সেই গর্তে ছিলো ইয়া বড় এক কাঁকড়া। কাঁকড়া তার দাঁড়া দিয়ে চেপে ধরেছে মিয়াভাইয়ের বামহাতের তর্জনী। ডাঙায় উঠে আসার পরে সে এক রক্তারক্তি অবস্থা। আঙুল ফুটো করে দিয়েছে। সেই ক্ষত আজও হালকা রেখা এঁকে মিশে আছে মিয়াভাইয়ের আঙ্গুলের ডগায়। আজকে আসার সময় ফুফু বারবার করে বলে দিয়েছে যেন কোন গর্তে হাত না দেয়।
          

      
আমরা শাপলা চেউচির গোড়ায় হাত দিয়ে মাছ তালাশ করছি। দ্বীপ্ত ভাইয়া খারাই হাতে পাড়ে বসে আছে। সেও নামতে চেয়েছিলো। মিয়াভাই নামতে দেয় নাই। ট্যাংরা মাছে কাটা মারার ভয় দেখিয়ে বসিয়ে রেখেছে। রহিম ফিক করে হেসে ফেলেআমাকে মুখ লুকিয়ে বলে, “টেংরা মাছের কাটা মারাকে কেউ ডরায় নাকি” মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পরে এখন মাঠ জুড়ে নাড়া আমাদের দেশে ধানের বিচালিকে নাড়া বলে। সেই নাড়া কিছু ছিড়ে এনে জড়ো করে দ্বীপ্ত ভাইয়ার বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পা ছড়িয়ে বসেছেন তিনিকাঁদের গামছা খানা পাগড়ীর মত মাথায় জড়িয়ে নিয়েছেআমাদের এলাকায় মাছ রাখার পাত্র কে খারাই বলে। অনেক এলাকায় এটাকে খালুই বলতে শুনেছিপ্রথম মাছটি ধরা পড়ল মিয়াভাইয়ের হাতে। বড় সাইজের একটা টাকি মাছ। মাছটা তিনি দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিকে ছুড়ে দিলেন। পানির কিনারা থেকে অল্প কিছু উপরে গিয়ে পড়ল টাকি মাছটাদ্বীপ্ত ভাইয়া দ্রুত মাছটা তুলে খারাইয়ে রাখতে গেলো। কিন্তু টাকি মাছ বেশ পিছলা এবং তিনিও মাছ ধরায় বেশ অপটু বোঝা গেলো। ঢাকা শহরের ধারে কাছে মনে হয় কোন মাছ ধরার জায়গা নেই। মাছটা দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত থেকে ফসকে গিয়ে পানিতে পড়লো। ভাইয়া হা হা করে হেসে উঠলো। বন্ধুর দিকে চোখ টিপ মেরে বললো,

‘ কিরে দীপ্ত, এখনো টাকি মাছটাই ঠিকমত আয়ত্বে আনতে পারিস না।

দ্বীপ্ত ভাইয়াও সেই কথায় হেসে উঠলো। আমি আর রহিম কথার মানে বুঝলাম না। কিন্তু আমরাও হেসে দিলাম। হাসি বড়ই সংক্রামক রোগ। একজনকে হাসতে দেখলে দর্শকেরও হাসি পায়। দ্বীপ্ত ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন , তেলওয়ালা টাকি পিছলে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক

ঘন্টা খানেকের ভেতর আমরা অনেক মাছ ধরে ফেললামকৈ, টাকি, শোল, পুটি, টেংরা, খলিশা মাছে আমাদের খালুই অর্ধেক ভরে গেছে। ভাইয়া বেশ কয়েকটা ঢ্যাপ তুলে দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিকে ছুড়ে মারলো। শাপলার যে ফল হয় ওটাকে বইয়ের ভাষায় কি লেখে জানি না, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ওটা ঢ্য্যাপ নামেই পরিচিত। আমরা হাত ধুয়ে এসে সবাই বসে ঢ্যাপ খেয়ে নিলাম। ঢ্যাপের ভেতর অজস্র বিচি থাকে। এই বিচি খেতে ভালোই লাগে। যদিও অনেক বেশী খেলে পেট খারাপ করার সম্ভাবনা থাকে। শীতের রোদ ছুয়ে আসা একটা বাতাস বইছে। ঠান্ডা গরমের মিশেল। অনেকটা টক মিষ্টির মত। ভালোই লাগছে। আমি নাল সহ একটা শাপলা নিয়ে চেইন গাঁথা শুরু করলাম। চেইন গাঁথা শেষ হলে লক্ষ্য করলাম দ্বীপ্ত ভাইয়া সেটা বেশ মনোযোগ নিয়ে দেখছেন। আমি নালের মাথায় গিঁট দিয়ে দিলাম। হঠাৎ কোন কিছু না ভেবে সেটা দ্বীপ্ত ভাইয়ের গলায় পরিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটু বিব্রত হলে তিনি নিজেকে দ্রুত সামলে নিলেন। হেসে উঠে বললেন, কি ছোট মিয়া ক্লাসের বান্ধবীদের কি এভাবে মালা পরিয়ে ছাড়ো নাকি। কোন মালাবদলের গল্প আছে নাকিবলো শুনি।

মিয়াভাইয়ের সামনে আমার লজ্জা লাগলো। আমি কিছু না বলে পানিতে নেমে গেলামহাতড়ানো শুরু করলাম একা একা। একবার চোরা চোখে ডাঙার দিকে চেয়ে দেখলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া খালের দিকে চেয়ে আছে। গলায় তার শাপলার চেইনে ঝোলানো মালা। নেকলেসের মত ঝুলছে শাপলা ফুলটা। এই মানুষটার প্রতি আমার অন্যরকম একটা টান এসে গেছে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যরকম ভালো লাগে। এই ভালোলাগাটা আমার কাছে অচেনা। খুব অচেনা। অচেনা ধরনের এই ভালো লাগাটাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না। তার দিকে তাকাতে কেন ভালো লাগে বুঝি না। এটাকেই কি ফ্যান্টাসি বলে। চোরা চোখো, সোজা চোখে তার দিকে কতবার যে তাকিয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। অনেকবার চোখাচোখি হয়ে গেছে। ভাইয়া হাসলেনমিও লাজুক হেসে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম

মিয়াভাই আর রহিম বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে হাতড়ানো শুরু করেছেনআরেকবার তাকাতে গিয়ে দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখে চোখ পড়ে গেলো। তিনি উঠে দাঁড়ালেনআমার দিকে হাঁটা শুরু করলেনজিন্সের প্যান্ট হাটুর নিচ পর্যন্ত গোঁটানো। ফর্সা ধবধবে পা। হালকা কিছু পশম তাতে। কাঁদার ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে ফর্সা সেই পা। আমার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ভাইয়া এসে আমার পাশে উপুর হয়ে অপটু হাতে মাছ হাতড়ানো শুরু করলেন। হঠাৎ তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন। এই প্রথমআমি তার দিকে তাকালাম। বড় মধুর সেই ডাক।

‘ ধন্যবাদ শুভ্র।

‘ ধন্যবাদ কেন?

‘ তুমি যে গতকাল থেকে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকছো আমার বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে নিজের একটা ছোট ভাই পেয়েছি আমি।


এই কথার পরে কি বলা উচিত আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। চুপ করে থাকলাম। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তিনিই নিরবতা ভাঙলেন।

‘ শুভ্র, আমি লক্ষ্য করেছি মাঝে মাঝে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকো। তোমার চোখের চাহনীতে মুগ্ধতা আছে। শহর থেকে আসা মানুষকে দেখে গ্রামের মানুষের এরকম মুগ্ধতা কখনো কখনো হয়ে থাকে। সেটা হেয়ার স্টাইল কিংবা পোষাকের কারণে হতে পারে। তোমার কোনটা ভালো লাগে।  আমার সাথে ফ্রিলি কথা বলতে পারো। ভাইয়ার বন্ধু বলে ভাইয়ার মত ভাবতে হবে এমন কিন্তু না।

এই প্রশ্নের উত্তর তো একটা দিতেই হবে। আমি বললাম,

‘ ভাইয়া নীল রঙ আপনার খুব পছন্দের?

‘ হুম। আকাশী নীল কালার বেশী পছন্দের।

‘ আপনি কি জানেন, নীল কালারের শার্টে আপনাকে খুব মানায়।

‘ তাই নাকি ?

‘ জ্বি হ্যাঁ।

‘ আমি জানি বলেই তো নীল কালারের শার্ট বেশী পরি। তুমি আমার শার্ট দেখ?

‘ হুম।

‘ ও তাহলে আমাকে দেখো না।

‘ আপনাকে দেখার কি আছে!

কি করে বলি ভাইয়া আমি শুধু তোমাকেই দেখি। দ্বীপ্ত ভাইয়া হা হা হা করে কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, তুই আমাকে ভাইয়া ডেকেছিস। সো আজ থেকে আর তুমি নয় তুই বলে ডাকবো। আর তুই সজলকে তুমি বলিস, আমাকে কেনো আপনি বলবি। আমাকে আপন ভাবতে পারিস না? আমাকে আজ থেকে তুমি বলবি।

আপনাকে আপন ভাবতে তো আমার ভালোই লাগে। আমি মাথা উপরে নিচে মৃদু ঝাঁকিয়ে বললাম, জ্বি ভাইয়া।

‘ এখনি তুমি বললাম।

‘ তুমি।

‘ এই তো । বেশ স্মার্ট ছেলে।

আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। তার খেয়ালই ছিলো না যে হাতে কাঁদা মাখা। শার্টে কাঁদা মেখে গেলো। তিনি হেসে দিলেন। আমিও হাসলাম।


-----------------------------------------------------------------