blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

প্রথম প্রেম

মুহিবুল হাসান খোকন। বছর বাইশের এক তাগড়া যুবক। ইদানিং বাসায় ফিরেন কম্পিউটারে বসা তার একটা নেশার মত হয়ে গেছে। কি এক অজানা আকর্ষণ তাকে চুম্বকের মত টানে। খোকনের গ্রামের বাড়ি যশোরের মনিরামপুরে। কপোতাক্ষ নদের তীরে  খেলা করে কেটেছে বাল্যকাল।  কৈশোরের দিন গুলো তার জন্য খুব সুখময় ছিলো না। বাবা  মাকে হারিয়ে জীবনের কঠিন পাশটা সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে কাঁচা বয়সেইআবেগ টাবেগকে সে প্রথম দিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি কখনোযৌবনের শুরুতে জীবিকার তাগিদে সে যশোর থেকে পাড়ি জমায় ইট পাথরে মোড়া এই ঢাকা শহরে। যশোর রেল স্টেশান থেকে শুরু হওয়া জার্নি বাই ট্রেন শেষ হয় কমলাপুরের প্লাটফর্মে। শুরুর দিন গুলো কি কঠিনই না ছিলো। ক্ষুধায় পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। পকেটের অবস্থা সংগীন। খাবারের দোকান গুলোতে বাহারি খাবার থরে থরে। সাজিয়ে রাখা। খাবারের ঘ্রাণ বাতাসে চড়ে ধাক্কা খায় নাকের বারান্দায়। আর সেই ধাক্কার রেশ গিয়ে পৌঁছায় মস্তিষ্কে। ক্ষুধাটা তখন চাগিয়ে উঠেফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে সরে যেতে হয়েছে। কত বেলা যে অভুক্ত কেটে যেত তার খোঁজ কেউ রাখে নাই। রাখার সময়ও ছিলো না। রাত যত দীর্ঘই হোক না কেন একটা সময় প্রভাত হয়খোকনের জীবনেও প্রভাত আসে। অনেক কষ্টের পরে আসে সোনালী সেই ভোর। সে নিজের প্রচেষ্টায় ছোট খাট একটা কোম্পানী দাঁড় করিয়ে ফেলে। মতিঝিলে একটা ফ্লাট কেনার চেষ্টা করে স্বপ্ন দেখে সোনালী এক সুদিনের।  

২০০৫ সালের কথা। খোকনের জীবনে নতুন কিছু ঘটে যায়। খোকন প্রেমে পড়েতাও একটা ছেলের প্রেমে। তার নিষ্ঠুর পৃথিবীতে এক চিলতে সুখের বাতাস বয়ে যায়। এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। ছেলেটার সাথে এখনও দেখা হয় নাই। সামাজিক যোগাযোগ সাইট Hi5 এ পরিচয়।  হাই ফাইভে খোকনের নাম নিও অরটন। আর সেই ছেলেটার নাম নীল রোহিত।  নীল লোহিত হলে নামটা অর্থপূর্ণ হত। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনিলের ছদ্মনাম নীল লোহিত। ছেলেটার আসল নাম হয়তো রোহিত। হয়তো বলছি এজন্য যে আজকাল ইন্টারনেটের অধিকাংশ মানুষ ছদ্মনামের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে।

রোহিত এবার ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। তার বাসা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। ছেলেটার কথা বার্তা রহস্যময়। কোন কিছুই খোলসা করত না। হেঁয়ালি ভরা কথা বার্তায় থাকত অন্যরকম এক সরলতা। আর এটাই খোকনের খুব ভালো লাগত। রোহিত সব সময় খোকনের খবর নিত। কি খেয়েছে, কখন খেয়েছে। এত এত প্রশ্নে সে মোটেও বিরক্ত হত না। নিষ্ঠুর পাষাণ এই শহরে সে এক মুঠো ভালবাসা খুঁজে পেয়েছে কম্পিউটারের ভিতর এক অজানা রাজ্যে। আর এটাই মূলত নেশার কারণ।  রোহিত খোকনকে বলত তার মতই কাউকে সে এতদিন খুঁজছিলো। এত দিনে সে খুঁজে পেয়েছে মনের মানুষ। খোকনকে সে অনেক অনেক ভালোবাসবে। চিরকাল খোকনের পাশে থাকবে। খোকন সমকামিতার স্বাদ পেয়েছে অনেক আগেই। কোন এক দুর্বল মূহূর্তে পরিচিত কারো দ্বারা। সমকামিতা সম্পর্কে খোকনের ধারণা অন্যরকম ছিলো। দুজন পুরুষ জৈবিক তাড়নায় একে অন্যের সাথে মিলিত হয় এটা সে বোঝে। শুক্রাণু ক্ষরণের পরেই সে তাড়ণা মিলিয়ে যায়। দুজন দুজনের জগতে ফিরে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুজন পুরুষে ভালোবাসা সম্ভব এটা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকতো না। দুজন পুরুষে আবার কিভাবে ভালোবাসা সম্ভব।  কিন্তু পাথরে ফুল ফুটিয়েছে রোহিত। খোকন সত্যি ভালবেসে ফেলেছে রোহিতকে। অনেকে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে। আর সে না দেখা কল্পনার মানুষটির প্রেমে পড়েছে।

রোহিতের সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা হয়। কত কত বিষয় নিয়ে তারা গল্প করে তার ইয়ত্বা নেই। কথায় কথায় রাগ, অভিমান, কথাকাটাকাটি সবই চলতে থাকে। বিছানায় শুয়ে কথা বলে খোকন। তার চোখ থাকে ঘরের সিলিং এর দিকে। কিন্তু সে চোখ কিছুই দেখে না। সে না দেখা রোহিতের মুখকে কল্পণা করে। যে মানুষের কথা এত সুন্দর, এত সাজানো গোছানো সেই মানুষটি কেমন দেখতে! কথায় কথায় সারা রাত কেটে যায়। ভোরের আলো ফোঁটে। ফোনের ব্যালেন্স ফুরিয়ে যায়। এক্সট্রা রিচার্জ কার্ড কিনে রাখে খোকন। রোহিতের সাথে কথা না বলতে পারলে তার কিছুই ভালো লাগে না। বুকের ভেতর আঁকুপাকু করে। মতিঝিল থেকে ক্যান্টনমেন্ট খুব বেশী দূরে নয়। সে একেকদিন বাসে করে চলে  যায় ক্যান্টনমেন্টে। রোহিতকে ফোন দেয়। রোহিত আসবে বলে। রাস্তা ধরে পায়চারি করে শক্ত মনের মানুষ সে। তবু হার্টবিট বেড়ে যায়। হালকা ঘাম ফুঁটে ওঠে কপালে। রোহিতের জন্য অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়তবু রোহিতের দেখা মেলে না। ফোনে ফোন দেয়। রোহিত ফোন রিসিভ করে না।  যে ছেলে ফোনে , চ্যাটিং এ ভালোবাসার কথার ফুলঝুরি ছোটায় সে সামনে কেন আসে না এটাই খোকন বুঝতে পারে না।  ভগ্ন হৃদয়ে সে নিজের ঘরে ফিরে আসে। খুব বিমর্ষ লাগে। মনে হয় ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে। কিন্তু ঘুম আসে না। রোহিতকে সে আবার মেসেজ পাঠায়। রোহিত মেসেজের উত্তর দেয়। আবার কথা শুরু হয়। কথার পিঠে কথা হয়। লাভ চ্যাটে রাত ভোর হয়।

খোকন আবার ক্যান্টনমেন্টে যায় রোহিতকে এক নজর দেখার আশায়। কিন্তু রোহিত দেখা দেয় না। হয়তো রোহিত তার পাশে দিয়ে হেঁটে গেছে কিন্তু সে চিনতে পারে না। এরকম বেশ কয়েকবার হলো। রোহিত কথা দিয়েও কথা রাখে নাইখোকন অপেক্ষা করে করে ফিরে এলো। শেষ দিন খোকন দুঃখ কষ্ট সহ্য না করতে পেরে রাগে ক্ষোভে একটা মেসেজ দিলো রোহিতকে, “আমাদের আর কোন দিন দেখা হবে না”

gay superman, gay cartoon



তাদের আর কোন দিনই দেখা হয় নাই। রোহিত সেই মেসেজের উত্তর দেয় নাই। খোকনও রোহিতকে আর কোন মেসেজ পাঠায় নাই। অনেক দিন কেটে যায়। রোহিত হারিয়ে গেলো। খোকন জানে এই শহরেই আছে। কিন্তু বের করতে পারে না মানুষটিকে। কিন্তু রোহিতকে দেখার উগ্র বাসনা খোকনের মনে আজো সুপ্ত রয়ে গেছে। হাই ফাইভের চল এখন আর নেইফেসবুকের পাতায় পাতায় এখনো সে রোহিতকে খুঁজে ফেরে। রোহিত নামে কোন আইডি দেখলে সে ঢু মারে তার প্রোফাইলে।  ছবি দেখে। চেনার চেষ্টা করে।

২০১৪ সাল। তরতর করে অনেকটা সময় কেটে গেছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে। খোকন আর আগের মত উগ্র ভালোবাসার কাঙাল নেই। বিয়ে করে স্থির হয়েছে। যদিও সমকামী জীবনকে সে ছাড়তে পারে না। খোকন এখন দুই সন্তানের জনক। ছেলেরা বড় হচ্ছে। এখন এসব ছাড়া উচিত বলে মনে করে সে।  তার সেই ছোট্ট কোম্পানী এখন বেশ বড় হয়েছে। অনেক লোক সেখানে কাজ করে। ইত্তেফাকের মোড় পেরিয়ে কিছু দূরে তার ফ্লাট। পাঁচতলায় দক্ষিন মুখো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে এখনো রোহিতের কথা ভাবে। প্রেম! প্রেম সে অনেক গুলোই করেছেঅনেক রোহিত এসেছে তার জীবনে। কিন্তু স্থির হতে পারেনি কারো সাথে।  খোকন আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে অনেক দিন হলো। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে তাকে আলাদা করে দেখার মত কিছু পায়নি আমি। প্রথম সে আমার নজরে আসে ২০০৯ সালের দিকে। তখন আমি সেন্ট মার্টিন সি বিচে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাত দিনের শিক্ষা সফরে এসেছি। আমি বরাবরই ফেসবুকের পোকা। যেখানেই যাই না কেন ফেসবুক আমার সাথে থাকে। সিবিচে বসে ফেসবুক গুতাই। দেখতে পেলাম খোকন তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে হানিমুনে এসেছে। কালার ম্যাচ করা পোশাক পরে তারা অনেক ছবি আপলোড করেছে। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করছে। পেছনে বঙ্গোপসাগরের নীল ক্যানভাস। আকাশে সাদা সাদা মেঘ।  আমি একটার পর একটা ছবি দেখে যাই। কিছুটা আফসোস বোধ করি। ইশ! আমার যদি কেউ থাকত। এভাবে ছবি তোলার সৌভাগ্য কি কখনো হবে আমার! আমি খোকনকে নক করিনি। কিন্তু মাথার ভেতর তার হানিমুনের ছবিগুলো গেথে গেছে। যদিও খোকন খুব বেশী বন্ধু বৎসল নয় তবু একটা সময়ে খোকনের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হয়।  রোহিতের গল্প শুনে আমিও রোহিতকে দেখার আগ্রহ বোধ করি। রোহিত কি আমার লেখা এই গল্প পড়বে কোন দিন!

টিনেজ ছেলেদের প্রতি আক্রোশ বোধ করে সে। কিছুদিন প্রেম করার পরে সে তাদের ছ্যাঁকা দেয়। টিনেজদের ছ্যাঁকা দিয়ে এক অসুস্থ আনন্দের স্বাদ পায় সেছ্যাঁকা খেয়ে কিশোর ছেলেগুলো কান্নাকাটি করে, ঘ্যান ঘ্যান করে। চাপা উল্লাসে ফেটে পড়ে তার মনমাঝে মাঝে নিজেকে তার স্যাডিস্টিক মনে হয় মনে হয় সে যা করছে সেটা উচিত নয়।  তবুও সে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে না। এই জগত থেকে বেরিয়ে যেতে চায় । কিন্তু পারে না। রোহিত কে দেখার ইচ্ছে গুমরে মরে। শুধু একবার দেখতে ইচ্ছে করে সেই ছেলেটিকে। নিশ্চয়ই এখন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। একবার তাকে জিজ্ঞেস করতে চায়। শুধু একবার “ভালো যদি নাই বাসবে তবে ভালোবাসা জাগালে কেন ?


কত প্রশ্ন যে নিরুত্তর রয়ে যায়। উত্তর দেবার মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। 

পুনশ্চঃ গল্পটি আমার এক বন্ধুর অনুরোধে তার নিজের জীবনের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। তার আশা এই গল্পটি পড়ে রোহিত যদি তার কাছে ফিরে আসে। কি বিচিত্রই না মানুষের প্রত্যাশা!