blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২৫

দরজায় করাঘাতের শব্দ সেই সাথে মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো, ছোড ভাই , বেহান বেলা আর কত ঘুমাবে। ওঢো।

আমি ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না, কে আমাকে ডাকছে। মা ফুফুর গলা তো এরকম না। শেষ রাতের দিকে বোধহয় ঘুমিয়ে গেছিলাম। দুচোখ ঘুমে বুজে আসছে। ঘুম জড়ানো স্বরেই জিজ্ঞেস করলাম , কে ?

ওপাশ থেকে খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এলো।  "বেশ মানুষ তো তুমি! গত রাতে সাথে করে আনলে আর এখন চিনতেই পারছো না।  "



আমি এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারি নাই। বহুকালের অভ্যেষবশত রহীমের খাটের দিকে তাকালাম। রহিমের খাট কোথায়? খাটের বদলে সেখানে একটা টেবিল। টেবিলের উপর একরাশ বই পত্র ঝাঁপ মেরে রাখা। এবার সব ঝাপসা পরিষ্কার হয়ে এলো। শালিক খালী, সুন্দরবন সব স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিলো গত রাতে। বহু বহুকাল পরে।

আমি ধরমড় করে উঠে বসলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে দরজা খুলে দিলাম। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কনা ভাবি। হাতে চায়ের কাপ। হাসি মুখে বললেন, টিকটিকির ছোট ভাইটিও দেখি ঘুমে কম যায় না। চা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। দেখতো খাওয়া যায় কিনা?

আমি হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিলাম। বহুদিন পর ঘুম থেকে উঠে এভাবে বেড টি খাওয়া হয় না। একাকি জীবনে সব নিজেকেই করতে হয়। ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে বানাতে আর বেড টি খাওয়ার মুড থাকে না।
চা ভালো হয়েছে। ফার্স্ট ক্লাস চা।

‘ চিনি ঠিক আছে।  তিন চামচ চিনি।
‘ জি।  তিন চামচ চিনি খাই এটা কিভাবে জানলেন ?
‘ গতকালকেই লক্ষ্য করেছি । চিনি বেশী খাও। এত মিষ্টি খাওয়া ভালো না রক্তে সুগার বেড়ে যাবে।

আমি হাসি দিলাম। একাকি এই জীবন শুধু অর্থহীন ভাবে টেনে নেয়া। তাতে চিনি বাড়লেই বা কি আর কমলেই কি ! মজা করে বললাম, বেশী চিনি খাই যাতে ব্যবহার মিষ্টি হয়। এমনিতেই বন্ধুরা সবাই বলে আমি রগচটা। হঠাৎ করে রেগে যাই।

ঘরে ছড়ানো ছিটানো বইয়ের দিকে তাকিয়ে কনা ভাবি বললেন, ঘরের এই হাল কেন ? সাপ খোপ বাসা বাঁধে নাই তো ওই বইয়ের দঙ্গলে ? জলদি বিয়ে করো। বউমা এসে সব জঞ্জাল দুর করে দিক।

আবার বিয়ের কথা। এই বিষয়ে উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। কিন্তু আজ আর উত্তর দেয়া লাগলো না। অক্ষর তার ছোট পা ফেলে দৌঁড়ে এলো।

‘ চাচ্চু কোলে নাও। কোলে উঠবো।
কোলে নিয়ে তার তুলতুলে গালে টুক করে একটা চুমু খেয়ে বললাম, কি ব্যাপার্। এতো সকালে আমার ছোট আব্বু এত ফিটফাট কেন?
‘ চাচ্চু, ইউ ফরগট? আজ মর্নিং এ না আমরা ওল্ড বাংলার ক্যাপিটাল দেখতে যাবো।
‘ স্যরি আংকেল। একদম মনে ছিলো না। আমি পাঁচ মিনিটেই গুছিয়ে নিচ্ছি

ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা ভাবী এত জায়গা থাকতে সোঁনারগাঁয়ে কেন। সেখানে তো দেখার মত কিছু নেই।

‘ আসলে তোমার ভাইয়া সবসময় অক্ষরের কাছে দেশের গল্প করে। প্রাচীন বাংলার গল্প এত করেছে যে ছেলের ধারণা সোনারগাঁ অনেক সুন্দর একটা জায়গা। তাকে দেশে আশার আগে জিজ্ঞেস করেছিলাম , দেশে গিয়ে প্রথম কোন জায়গা দেখতে চাও। সে বললো পানাম সিটি। তাই আমরাও ট্যুর প্লানে পানাম সিটি রেখেছি সবার আগে।

‘ ওকে ভাবি আমি রেডি হয়ে নেই। দ্বীপ্ত ভাইয়া উঠেছে ?
‘ সেও তো তোমার পাঁচ মিনিটের দলে। ডেকে এসেছি। এখনো ওঠেনি বলে মনে হয়। আমরা মেয়েরা নাকি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে ঘন্টা খানেক লেট করি। তাই সেই অপবাদের আগেই উঠে পড়লাম।  ফ্রেশ হয়ে  এসো। নাস্তা করবে ।

‘ নাস্তাও বানিয়েছো।
‘ এসেই দেখো।
‘ কষ্ট করে নাস্তা বানানোর কি দরকার ছিলো।

ভাবি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন, নিজে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন! আর আমাদের বলেন, কষ্ট করে নাস্তা বানানোর কি দরকার ছিলো। তোমার কাজের লোকের রান্নার মুরোদ আমার জানা আছে। যাও কথা না বাড়িয়ে জলদি ফ্রেশ হয়ে আসো।






লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২৪

নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম ,
বন্ধুর কাছে মনের খবর কেমনে পৌঁছাইতাম।

বাংলাদেশ বেতারে রুনা লায়লার গলার গান আজ আমার দুপুরের হাহাকার বাড়িয়ে দিলো। আজ এক মাস হয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ের কথা আমি সারাক্ষন ভাবি। সেকি একবারও আমার কথা ভাবে না। এক লাইনে একটা চিঠি লিখে পাঠানোর সময় কি তার হয় না !

শেষ বিকেলে এলো চিঠি। বাবার পকেটে চড়ে। এক খামে দুটো চিঠি। একটা আব্বার, আরেকটা আমার্। দ্বীপ্ত ভাইয়া পাঠিয়েছে। তারআনে আব্বা দুটো চিঠিই পড়েছেন। আমি কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠিখানা নিলাম।

নিজের ঘরে গিয়ে জানালার কাছে আলোয় মেলে ধরলাম চিঠির নীলচে পাতাছোট চিঠি। মাত্র কয়েকটা লাইন তাতে লেখা।

প্রিয় শুভ্র,
            শুভাশিষ নিও। আশা করি বাড়ির সবাইকে নিয়ে কুশলে আছো। পরসমাচার তোমাদের বাড়ি থেকে আসার পর পরীক্ষার ডেট পড়ে যাওয়ায় প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তাই তোমাকে চিঠি লেখা হয় নাই। তোমার পড়াশুনা টা কেমন হচ্ছে ? মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।

ভালো থাকবে। আমার জন্য দোয়া করবে। আর সময় পেলে চিঠি দিও।

ইতি,
তোমার দ্বীপ্ত ভাইয়া।

পুনশ্চ: আমার ঠিকানা খামের উপর পাবে।

অল্প কয়েকটি লাইন। আমি চিঠিখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পড়তে লাগলাম। প্রতিবার চিঠিখানাকে নতুন বলে মনে হলো। এই কয়টি লাইন আমার সময়কে রঙিন কর দিলো। মনে হচ্ছে দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার সাথে মুখোমুখি কথা বলছে। আজ মন আমার অনেক ভালো।  চিঠির অক্ষরগুলো মৌমাছির মত আমার চারপাশে গুনগুন করতে লাগলো। আমি তখনি চিঠির উত্তর দিতেবসে গেলাম। মনের রাজ্যে হাজার কথার ভিড়। কোনটা রেখে কোনটা লিখি ! সম্বোধন কি লিখব সেটা লিখতেই  কয়েক পাতা নষ্ট হলো। প্রিয়তম, হৃদয় আমারজানপাখি  বাদ হয়ে শুধু থাকলো দ্বীপ্ত ভাইয়া।

বাতাসে ভেসে যেতে লাগলো আমাদের সময়। রাগ অভিমান , প্রেম ভালোবাসা সব  চিঠির কাগজে ডানা মেলত। দুত হয়ে হাজির হত পোস্ট অফিসের পিয়ন। সপ্তাহে  আমার নামে একটি দুটি চিঠি আসা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রেডিওতে মনির খানের শোনা গানের দুকলি একদিন লিখে পাঠালো দ্বীপ্ত ভাইয়া। আমার খুব হাসি পেলো। কারো সাথে শেয়ার করতে পারি নাই। তেঁতুল তলায় ওইপাশের বাগানে গিয়ে একা একা হো হো করে হাসলাম।


চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙ্গা হাতে, প্রদীপ জ্বালাইয়া নিভাইয়া ...


লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২৩


সময় যেন আর কাটে না, বড় একা লাগে ...

দ্বীপ্ত ভাইয়া চলে যাবার পর খুব একা মনে হয়। চারপাশের সেই চিরচেনা মুখ গুলো আগের মতই আছে। তবুও নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মনে হয়। জন মানুষের মাঝে থেকেও আমি বড় নি:সংগ বোধ করি। শুধু মনে পড়ে সেই মুহুর্তগুলোকে যা আমাকে দিয়েছে  কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতি।  আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিয়ে যাওয়া শার্টটা পরি। শার্টটা পরলে মনে হয় দ্বীপ্ত ভাইয়া আমাকে আলিংগন করে আছে। আমি তার স্পর্শ পাই, তার শরীরের গন্ধ খুঁজে ফিরি এই শার্টে। আমি মিয়াভাইয়ের ঘরের তালা খুলি। আমার প্রথম মিলনের সাক্ষী এই পালংক খাট। আমি খাটের উপর শুয়ে থাকি। বালিশে মাথা রাখি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যবহার করা বালিশে চুমু খাই। চোখ ফেটে জল আসে। একা একা কাঁদি।

বিকেলের হেটে বেড়াই শালিক খালী নদীর পাড় ধরে।  সবুজ ঘাসে মুখ ডুবিয়ে এক মনে ঘাস খাচ্ছে নতুন দাদীর ছাগল দুটি। ছগীর শেখ খ্যাওলা জাল ছূড়ে মাছ ধরছে। খারাই হাতে মাছ কুড়াচ্ছে তার বাচ্চা মেয়েটা। দুটি সাদা বক পাশাপাশি উড়ে গেলো বাঁদার দিকে। বাড়ির উঠোনের সব্জি বাগান থেকে ওলকপি তুলছে আর পান চিবুচ্ছে নতুন দাদী। বাঁশের সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা শুনছে ছাকা মাঝি ও গফুর গাছি।  ইমাম সাহেবের নাম কাইয়ুম মৌলভি। চার গ্রাম পরে লেবুপাতা  গ্রামে তার বাড়ি।  আমি সামনে এগিয়ে যাই। কিছুদুর পরে  সবুরদের বাড়ি। সবুরের দাদি সবুরকে গজা খাওয়াচ্ছে  বারান্দায় বসে।  মোড়লপাড়ার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম, কে যায়?


ঘরের দাওয়ায় বসে  জাল বুনছে মোজাম মিয়া। মোজাম মিয়া জন্মান্ধ। পৃথিবীর রূপ সে কখনো দেখেনি । তবুও সরস একজন মানুষ। আমাদের বিচিত্র সব গল্প শোনায় তার বর্ননা শুনলে চোখের সামনে  সিনেমার মত ভেসে ওঠে সব। আরব দেশের গল্প সে বেশী করে।  চোখে যারা দেখে না তাদের কান অনেক শার্প হয়। আমি হাঁটছিলাম আপনমনে খুব আস্তে  ধীরে। তাও সে শুনতে পেলো।  ডাক দিলো।

আমি উত্তর দিলাম , "আমি  " । দ্বীপ্ত ভাইয়া হলে বলত, আমি দ্বীপ্ত। আমার গলার স্বর শুনে মোজাম কানা আমাকে চিনতে পারলো, ও ছোড খুকা। আসো। এইহানে বসো। দুডো গল্প করি।

আমার তেমন কোন তাড়া নেই। বারান্দায় পাতা খেঁজুর পাটির উপর উঠে বসলাম।   রসের জন্য খেঁজুর গাছ কাটার আগে বাইল্লে কাটা হয়।  খেঁজুরের পাতা দিয়ে  পাটি বোনে চাচী। মোজাম কানা ভালো জাল বুনতে পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে জাল বোনে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। মহুয়া সুন্দরীর পালা, বেহুলা লক্ষীন্দরের পালা, ভানুমতির পালা সব তার মুখস্ত।  গলার সুরও চমৎকার্। জুম্মাবারে সে লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে চলে যায় মসজিদে। মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার আগে সে সুললিত  স্বরে গজল গায় দুই তিন খানা। গ্রামের বউঝিরা কাজের ফাঁকে  তার গজল শোনে। মোজাম কানার বিয়ে হয় গরীব এক চাষীর মেয়ের সাথে। একে তো গরীব চাষা তার উপর একখান ছেলের আশায় তার ছয়ছয়খান মেয়ে হলো পরপর । এত গুলো পেটের অন্ন জোগাতে সে চোখে সর্ষে ফুল দেখে। পারলে তো সে মেয়েগুলোকে গাঙের জলে ভাষায় দেয়। সেই ছয়  মেয়ের একজন মোজাম চাচার বউ। শত দু:খ কষ্ট মুখ বুঝে সহ্য করা আশ্চর্য্য সহনশীল এক রমনী। তাদের একটা ছেলে ছিলো। বেশ সুন্দর দেখতে । সবাই কোলে নিয়ে আদর করত। সবার কথা শুনে মোজাম কানা খুশীতে পুলকিত হত। ছেলের মুখে পিঠে, হাতে পায়ে সে হাত বুলিয়ে ছেলের সৌন্দর্য্য দেখার চেষ্টা করত।  গায়ের রং বাপ মাকে ছাড়িয়ে যায়তাই নিয়ে ওপাড়ার মেজদাদির মত লোকেরা এই চাচীর নামে সারা গাঁয়ে কুৎসা রটাতে ছাড়ে না। ঘটনার কোন সত্যতা ছিলো না। তাই একসময় আর কেউ ওসব কথায় গা করতো না। সাত বছর বয়সে তাদের ফুটফুটে ছেলেটি তিন দিনের কালাজ্বরে মারা যায়।

‘ চাচী কই ?
‘ ধান ভানতি গেছে শাবুদ্দি মোড়লের বাড়ি।  গরীব মানুষের বেটি, গরীব  মানুষের বউ সারা জীবন শুধু খাঁটে গেলো। সুখ পাইলো না একটু।

‘ চাচা , তোমার কি মন খারাপ ?
‘ নারে বাপ। মন খারাপ না।  নিত্যি অভাবের সংসারে মন খারাপকে পাত্তা দিলি কি জীবনের এতডা পথ পাড়ি দিয়ে আসতি পাত্তাম। বাজান বাঁইচে থাকতি আমারে নিয়ে খুব চিন্তা করত। বেশী জমিজমা নেই। কি হবে আমার? এই ভাবনায় তার রাইতে নিদ হইতো না। তার আওলাদকে ভিক্ষে করে খাতি হবে সারাজীবন। না। ভিক্ষে আমি করিনি। কতদিন শুধু নুন দিয়ে হাত খাইছি, কতক দিন তাও জুটতো না। খিদের জ্বালা বড় জ্বালারে বাপ। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না মানুষের্। তবু কখনো হাত পাতিনি কারো কাছে। যাকাত ফেতরা কেউ বাড়ি এসে দিয়ে গেলে নেই। এই টুকু না নিয়ে তো পারিনে। দুটো মানুষের পরনের কাপড় তো কেনা লাগে ।  জীবন কাটায়ে দিলাম ঘর আর বারান্দায়। এই জীবন যে কি কঠিন তা যে পার করে সেই শুধু জানে।

মাইনষে কয় কানা খুড়া বুবা মানুষগো আল্লাহ বেশী ভালোবাসে। আমার তো মনে হয় না আল্লাহ আমাগে ভালোবাসে। আমারে যদি আল্লাহ ভালোবাইসতো তাহলে কি কানা করে পয়দা করত । জাহান্নামের জীবন কি দুনিয়ার অপূর্ন জীবন থেকে কঠিন!  বুঝলে শুভ্র মিয়া। জেবন অনেকক কঠিন। জেবনে অনেক বালা মসিবত আসপে। কাছের মানুষ পর হয়ে যাবেতখন কিন্তু ঘাবড়ালি চলবে না।



এই সময়  চাচী ফিরে এলো। আঁচলে তার চাউল বাঁধা। মোজাম কানা ব্যকুল হয়ে বললো , " চাইল আনিছো। শিজ্ঞির ভাত চড়াই দাও। দুই দিনের খিদে চাগান দিয়ে উঠিছে চালের গন্ধে।  " চাচী আমার সাথে দুটো কথা বলে ঘরের বারান্দায় পাতা চুলায় আগুন ধরাতে বসলো। পাতার আগুনের ধোঁয়ায় সারা বারান্দা অন্ধকার হয়ে গেলো। আমি উঠে পড়লাম। দোকানের দিকে জোরে পা চালালাম।


দুই দিন। এই দুটি মানুষ দুই দিন না খেয়ে আছে। কারো কাছে হাত পাতে নি পেটের জন্য। অভুক্ত শরীরে আধা বেলা ধান ভেঙে সে কেজি পাঁচেক চাল নিয়ে ফিরেছে ঘরে।  শিমের মাঁচা থেকে কয়েকটা শিম ছিড়ে ভাতের হাড়িতে  দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়েছে  চাচী। চুলার আগুনের আভা চাচীর মুখে। সে মুখে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই।   নিজের অজান্তে দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২২

৯ ফাল্গুন, ২১ শে ফেব্রুয়ারী। মহা ভাষা শহীদ দিবস। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবস বাঙালীর আত্মত্যাগের , এই দিবস বাঙালীর আত্মত্যাগের্। এই একটি দিনে আমরা হিন্দু , মুসলমান, খ্রিস্টান হয়ে নয়, বাঙালী হয়ে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস তুলে ধরিখালি পায়ে বসন্তে ফোঁটা সজীব পুষ্পমাল্য হাতে, প্রভাতফেরীর সারিতে  প্রভাত সংগীতে সব বাঙালী ছূটে যাই শহীদ মিনারে। আমাদের সেই মিছিলে যোগ দেয় পৃথিবীর নানান ভাষাভাষী মানুষ।

একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীর অনুষ্ঠান ছিলো স্কুলে। সকালে চলে গেলাম এক গোছা ফুল নিয়েপথে দেখা হলো ওপাড়ার মেজ দাদির সাথে। পাড়া সম্পর্কীয় এই দাদিকে আমি বরাবরিই অপছন্দ করি। কথা লাগানো , কুটনামি ইত্যাদিতে তার জুড়ি মেলা ভার্। সকালে দুটো খেয়ে একটা পান মুখে পুরে সে পাড়া বেড়াতে বের হয়। ফেরে দুপুরের আগে। বলতে গেলে সবার হাঁড়ির খবর তার জানা। তাই সেভাবে কেউ ঘাঁটায় না । আমাকে দেখে বলে, কই যাও ছোড খুকা। শহীদ পূজো কত্তি ? মোচলমানের ছাবাল হয়ে তুমরা সব ক্যান যে হিন্দু গো লাহান পুজো করো। ক্লাসের বইতে এইসব ল্যাহা থাহেনি?

আমি কথা বাড়াই না। গতবছর আমি এই বিশিষ্ট তর্ক বাদীকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছি। তার ব্যাপারটা এরকম, আমি ঘুমিয়ে আছি, কেমন পারো আমাকে জাগাও দেখি।

রাস্তার পাশে পলাশ গাছ গুলোয় যেন আজ আগুন লেগেছে। সকালের রবি কিরণে লাল বর্নের ফুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। স্কুলে এসে দেখি বিলাস, সৌমিত্র, সাজ্জাদ, আরমান, কিশোর, অনিক, রুদ্র , সুস্মিতা, ছোয়া , ফারজানা সবাই এসে হাজির খালি পায়ে স্কুলের পোষাকে । সবার হাতে এক গোছা ফুল। ফারজানার হাতে কয়েকটা গোলাপ। এক গোলাপের সাইজ এত বড় যে আমরা প্রায় সবাই লক্ষ্য করেছি। কিশোর গোলাপ টা হাত করার জন্য ফারজানাকে পটানোর চেষ্টা করলো। ফারজানা কিছুতেই রাজি হয় না। শহীদদের উদ্দ্যেশ্যেই সে বাগানের সব থেকে বড় গোলাপটা আজ নিজ হাতে ছিড়েছে। ছিড়তে গিয়ে বামহাতের অনামিকা ছড়ে গেছে গোলাপ কাটায়। কিশোর মনোক্ষুন্ন হয়ে গজগজ করে। তোর  আঙুলে আজ মরিচ বাটা লাগুক। তোর গোলাপ ঝাড় উইপোকায় কাটুক। ফারজানা বদদোয়া শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে যায়। সে হাতের ফুলের গোছা ছুড়ে মারে কিশোরের মুখের  উপর্। কিশোর বড় গোলাপ টা কুড়িয়ে নিয়ে তাতে নায়ক রাজ্জাকের মত ভাব নিয়ে চুমু খায়। আমরা সবাই হেসে উঠি। ফারজানা গটগট করে চলে গেলো। সাজ্জাদ বলে, ওই কই যাস? সে উত্তর দেয় না। ছোঁয়ার সাথে ফারজানার সম্পর্ক ভালো না। তারা দুজন ছয়মাস কথা বলে তো বাকি ছয়মাস বলে না। ফারজানা ঠোঁট বাকিয়ে বলে, দ্যাখ, টাইগারের স্যারের কাছে নালিশ করতে গেছে।



কিছু পরে ঘন্টার টুংটুংটুং শোনা গেলো। অফিস ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পিয়ন চিৎকার করে সবাইকে শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হতে বললো। স্কুলের গেট থেকে ঢুকে বাদিকে শহীদ মিনার্। শহীদ মিনারের পেছনে বড় দুটো শিমুল তুলোর গাছ। শিমুলের ফুল পাতায় শহীদ মিনার জঞ্জাল হয়ে থাকে। আজ সব সাফ সুতরো করে রাখা হয়েছে। হেডস্যার সব শিক্ষকদের নিয়ে প্রথমে পুষ্পার্ঘ অর্পন করলেন। বাংলা স্যারের তত্বাবধানে বিভিন্ন ক্লাসের মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে গাইছে ফেব্রুয়ারীর থিম সং

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভূলিতে পারি...


একে একে আমরা সবাই ফুল দিলাম। কিশোর ফারজানাকে কোথা থেকে ধরে এনেছে। ফারজানার হাতে ফুলের গুচ্ছে শোভা বাড়িয়েছে সেই গোলাপ। ফুল দিয়ে বাইরে এসে দেখি গোলাপটি ফারজানা কিশোরের হাতে গুঁজে দিলো।আমারও ইচ্ছে করছে আমার জান পাখিটার হাতে একটা টকটকে লাল গোলাপ ধরিয়ে দিতে। আমার জান পাখিটা এখন কোথায় ? শাহবাগে নাকি শহীদ মিনারের প্রভাত ফেরীর মিছিলে! নাকি বন্ধের দিন বলে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে ঢাকা যেতে।

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২১

পুরো ১০ দিন আমি স্কুলে যাই না। চুপিচুপি স্কুলে ঢোকার আগে হেডস্যারের সাথে দেখা।

‘কি ব্যাপার, শুভ্র সাহেব নাকি! তা এদিকে কি মনে করে! পথ ভুল করে আজ এদিকে এলেন নাকি!’

আমি নিরুত্তর হয়ে স্যারের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার আমাদের সবসময় মাথা উচু করে চলার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার সামনে এলে আমাদের উঁচু মাথা নিচু হয়ে যায়। বিনয়ে নয় ভয়ে। স্যার মহা তেজী। অন্য স্যারেরাও স্যারকে ভয় পায়, সমঝে চলে। ভয় পান না  শুধু সুশীল স্যার সুশীল স্যার যে হেডস্যারেরও স্যার। স্কুলের বড় ভাইয়ারা আড়ালে হেডস্যারকে বলে টাইগার স্যার তিনি চিৎকার করলে নাকি বাঘের হালুম ডাকের মত শোনা যায়।

ক্লাসে ঢুকে আমার চিরাচরিয়ত স্বভাব অনুযায়ী বামপাশের দ্বিতীয় বেঞ্চের ডান কোনার সিটে বসলাম। ক্লাসের তিন সারি বেঞ্চের দুই সারি ছেলেদের। এক সারি মেয়েদেরমেয়েদের সারিতে প্রথম বেঞ্চে বসা সুস্মিতা গলা তুলে বললো, ‘কিরে দোস্ত, কোথায় ডুব মেরেছিলি আজ কয়েকদিন। খুব ডেটিং করলি না?

ডেটিং এর কথা শুনে ক্লাসের সবাই মনযোগ আকর্ষিত হলো আমাদের দিকে। স্কুল লাইফে ডেটিং এক নিষিদ্ধ জিনিসের নাম। সুস্মিতা সবাইকে বানিয়ে বানিয়ে আমার নামে প্রেমের গল্প শুনিয়ে দিলো। আমি নাকি কোন মেয়ের সাথে তিন মাস চুটিয়ে প্রেম করছি। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কাছের বন্ধুদের অনেকের কোনায় সুক্ষ ঈর্ষা, আবার কারো চোখে সলাজ অভিনন্দনের ভাষা।

আমি ক্লান্ত স্বরে সুস্মিতাকে বললাম, ‘দোস্ত তুই উপন্যাস লেখা ধর। ভালই মার্কেট পাবি’।

স্কুলে শেষে বাড়ির পথ ধরলাম। সরকার পুকুর পাড়ে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় ইটের তৈরি হাউজে। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তারা পানীয় জলের চাহিদা মেটায় এই পুকুর থেকে। পুকুরের পাড় অনেক উঁচু। বৃষ্টি, বন্যায় আশপাশের বিল পুকুর তলিয়ে গিয়ে একাকার হয়ে যায় কিন্তু উঁচু পাড়ের কল্যাণে সরকার পুকুর তলায় না। এই পুকুরে জনসাধারণের গোসল করা নিষিদ্ধ। ঘাসের বুকে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নি:সঙ্গ এক পাখি উড়ে যাচ্ছেডানায় তার শেষ বিকেলের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। কাদের একটা বউ পানি নিতে পুকুরে নেমেছে। আমাকে দেখে ঘোমটা দিলো। নতুন বউ হবে। তা না হলে এত জড়সড় হত না। পুকুর পাড়ে বসে থাকা দৃষ্টিকটু দেখায়। আমি হাটা শুরু করলাম। মদ্যির ডাঙার এসে থমকে দাঁড়ালাম। সেদিনের ছাই গুলো আমাদের বনভোজনের স্মৃতি হয়ে পড়ে আছেখেঁজুর গাছের আড়ালে দেখা গেলো গফুর গাছিকে। তোয়ালে খানা চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। ইষৎ হলুদাভ তোয়ালের উপর বড় করে কয়েকটা গোলাপ ফুল আঁকা।

শুকনো পাতা মাড়িয়ে আমি হেঁটে চলি। আমার সাথে একরাশ স্মৃতি হয়ে হেঁটে চলে দ্বীপ্ত ভাইয়া। এক শহুরে যুবক, যার জামার কাটিং, চুলের স্টাইল আমাকে বিমুগ্ধ করেছিলো। সব কিছু ছাড়িয়ে তার ব্যক্তিত্ব আমাকে এখনো মুগ্ধ করে রেখেছে। অন্যকে অনুকরন করার, অন্যের মত হওয়ার এক বিশাল প্রবনতা কাজ করে কৈশোরে।

রাস্তার বুকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগিয়ে আসছে সবুরসবুর জন্ম থেকে বোবা এবং পঙ্গু। বাপমায়ের কোল জুড়ে আসা প্রথম সন্তান। সবুর যেদিন বসা শিখলো সেদিন বাবা মায়ের কি আনন্দ। সবুরের দাদি জুম্মা ঘরে গিয়ে বাড়ির বড় মোরগের রান্না করা মাংস দিয়ে গালে ভাত দিলো। মাংসের ঝালে সবুরের কচি গালে উত্তাপ আনে। সে কেঁদে দেয়। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে। দাদি শাড়ীর আঁচলে মুখ মুছে দেয়। ছেলের বয়স দুই পেরিয়ে যায়, তিন পেরিয়ে যায় তবু সবুর হাটা শেখে না। বাবা মা সবর করে। হুজুরের পানিপড়া, কবিরাজের তাবিজ কত কিছুই করলো।  একসময় তারা হাল ছেড়ে দিলোপরে তার দুটি বোন একটি ভাই জন্মে। অভাবের সংসারে  লুলা গুঙ্গা ছেলেটার প্রতি আর সেভাবে লক্ষ্য করে না। মুখের লালা চোয়ালে লেপ্টে যায়। তাতে ধুলোর কালো আস্তরন পড়ে। দাদি মাঝে মাঝে  বল সাবান দিয়ে ভালো করে ঘসে মেজে গোছল করিয়ে দেয়। কিন্তু বিকেলে দেখা যাবে আবার সেই ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

মাটিতে ঘসে ঘসে সে অনেক দূর চলে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম , সবুর কই যাবি ?, সবুর বয়সে আমার থেকেও বড়। কিন্তু অপুষ্ট শরীরে তাকে ১০ বছরের ছেলে মনে হয়। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তাকে পাগল বলে ডাকে। সবুর হাতের বাঁকা আঙুল গুলো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। বোবা মুখে কথা ফোঁটে না। আউ আউ শব্দ হয়। মুখের লালা ঝরে পড়ে মাটিতে। আমি তাকে বললাম, বাড়ি যা। সে কি বুঝে হাসির মত শব্দ করে। উপরে নিচে মাথা ঝাকায় কয়েকবার্। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিলে সবুরের দাদির মত কাউকে মাঠে চরা গরুর গোবর কুড়াতে দেখলাম। আমি গলা চড়িয়ে তাকে ডাকলাম। সবুরের দাদিই ছিলো। সে বিরক্ত মুখে  গোবর মাখা হাতে এক চড় বসিয়ে  দিলো সবুরের পিঠে। আমি বললাম, মাইরো না। ও কি আর বোঝে!

‘মারি কি আর সাধে বাপ। রাস্তার ধারে কত পইর আছে। পইড়ে ডুবে মরলি কিডা দেইখতো। আমি ঘুটে নুড়ি বানানির জন্যি এক ঝুড়ি গবর কুড়োতে আলাম। বাড়িতে ওর মা ছিলো। সে এট্টু দেখে রাখলি তো পাত্ত। গুঙ্গা ছেইলে বলে মা নিজির হাতে ছাবাল ডারে মৃত্যুর দিকি ঠেইলে দেবে! ইরাম ডাইনি মা আমি এই জীবনে আর দেই নি’

অদৃশ্য পুত্র বধুর উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে সবুরকে বাড়ির দিকে টানতে থাকে।  সবুর উল্টো দিকে টানে। সে উল্টো পথে কোন দিকে যেতে চায়! তার কি ধারণা উল্টোপথে তার এই জীবন থেকে মুক্তির দুয়ার খোলা  আছে?


আমি একটা মহা গাধা। আমাকে উত্তমরূপে থাপড়ানো উচিত। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানাটা রেখে দিলে আমি তো চিঠি লিখতে পারতামদ্বীপ্ত ভাইয়া তো আমাদের বাড়ির ঠিকানা সব জানে আর না জানলেও মিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সে কি একটা চিঠি দিতে পারে না!


লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২০

লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ পল্টনে বসে থাকলাম। রহিম তাগাদা দেয়। ‘ছোড ভাই, ওঠো। বাড়িত যাবা না। সইন্ধ্যে হয়ে আইলো। শীত কত্তিছে।’
        
রহিম চাদর আনে নাই। শীত লাগাটাই স্বাভাবিক। যে পথে গুড়গুড় করে লঞ্চ চলে গেছে সেদিকে আরেকবার ফিরে তাকালাম। চোখের আয়নায় দ্বীপ্ত ভাইয়ের হাস্যোজ্বল মুখ ভেসে উঠলো। লঞ্চের নাম মেসার্স মোহাম্মাদি। লঞ্চের ছাদে একটা প্লেনের রেপ্লিকা আছে। তাই এলাকায় এটা প্লেন লঞ্চ নামে পরিচিতকয়রা নদী ধরে লঞ্চ এগিয়ে যাবে, হড্ডার মোহনা হয়ে শিবসা নদীতে পড়বে। শিবসা নদী দক্ষিনে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তাই শিবসা নদীর প্রশস্ততা অনেক বেশী। বর্ষায় শিবসা হয়ে ওঠে প্রমত্তা, মাছ ধরা জেলে নৌকা গিলে খায়। গরু বাছুর মানুষ পর্যন্ত গিলে খায়। তবু তার ক্ষুধা মেটে না। শীতে শিবসা অনেক শান্ত। শিবসা পেরিয়ে নলিয়ান ঘাট তারপর আবার কোনাকুনি পাড়ি দিয়ে শান্তা লঞ্চ ঘাট। এরপর তৃতীয় বারের মত শিবসা পাড়ি দিয়ে জয়নগর ঘাট হয়ে লঞ্চ ঢোকে চুনকুড়ি নদীতে। কালিনগর, দাকোপ, চালনা ঘাট পেরিয়ে লঞ্চ এসে পড়ে পশুর নদীর মোহনায়। চালনা ঘাটের পর আর কোন ঘাট নেই। পশুর নদী বেয়ে লঞ্চ ঢোকে বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদীতে। এরপর রুপসা নদীর নতুন বাজার ঘাট পেরিয়ে  আইডব্লিউর লঞ্চ ঘাটে গিয়ে  নামবে দ্বীপ্ত ভাইয়েরা।

খুলনা শহরের সোনাডাঙা বাস স্ট্যান্ড থেকে ঢাকার বাস ছাড়ে। বাস ছুটবে নতুন রাস্তার মোড়দৌলতপুর, ফুলবাড়ি গেট, শিরোমনি, ফুলতলা পেরিয়ে যশোরতারপর নড়াইলের আড়পাড়া দিয়ে মাগুরা, ফরিদপুর অতিক্রম করে পৌঁছে যাবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। এই  ফেরিঘাটকে খুলনা সাতক্ষীরার মানুষ আরিচা ফেরিঘাট নামে চেনে। যদিও মুল আরিচা ঘাট আরো দূরে।  ফেরিঘাটে অনেক জ্যাম থাকে। ফেরি ঘাট পেরিয়ে মানিকগঞ্জ সাভার হয়ে ঢাকার গাবতলি বাস স্ট্যান্ড। দ্বীপ্ত ভাইয়েরা গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তখন কি দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার কথা সত্যি মনে রাখবে!

‘ ছোড ভাই জোরে হাঁটো। জাড় কত্তিছে’

‘চাদর না নিয়ে আসছিস ক্যান বলদা!’

‘খেয়াল ছেলো না’।

বাতাসটা আজ অনেক ঠান্ডা। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। জোরে হাঁটার চেষ্টা করছিকিন্তু পা চলতে চাইছে না যেন। পায়ের পাতা দুই মন ভারি বলে মনে হচ্ছে। রহিম কিছু দূর হেঁটে গিয়ে আমার জন্য থামছে বারবার্।

বাসায় পৌঁছানোর কিছু পরে এশার আযান শোনা গেলোআজ অপরিচিত কেউ আযান দিচ্ছে। ইমাম সাহেব মনে হয় ছুটিতে গেছে। অন্যদিন হলে কে আযান দিচ্ছে এটা বের করার জন্য রহিমের সাথে আলোচনা শুরু করে দিতাম। স্বাভাবিক ভাবে রহিম জিজ্ঞেস করলো‘ছোড ভাই কওতো কে আইজ আয়জান দিতিছে?’  

প্রশ্ন করে রহিম আমার বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন। বিছানার উপর গলা পর্যন্ত লেপে ঢেকে আমি শুয়ে আছি। উত্তর না পেয়ে রহিম আপন ভাবনায় ডুব দিলো।

মা খেতে ডাকলো। বারান্দার কোনায় পোষা শালিক মন্টু থাকলে সেও মায়ের সাথে ডাক দিয়ে বলতো, ‘ভাত খেয়ে যা’ মন্টুর খাঁচা এখনো আছে। সেখানে এখন অপরিসীম শূন্যতা। সেই শূন্যতা এখন আমি অনুভব করি বুকের গভীরে। আমি লেপের ভেতর থেকে বললাম, ‘আজ রাতে আমি খাবো না মা’ খাওয়ার রুচি নেই। রহিম খেতে গেলো। রহিম জগতের সুখী মানুষদের একজন। খাওয়া ঘুম আর গরুগুলোকে দেখাশোনার চিন্তা ছাড়া তার মাথায় আর অন্য কিছু নেই। দুটো খেতে পেলেই সে নাক ডেকে ঘুমাতে পারে।

মা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাবি না কেন? খাবার তোর ঘরে পাঠিয়ে দেবো?’

‘নাহ। একদম খিদে পায়নি’।

আম্মা বললেন, ‘শীতের রাত বড় রাত। সারা রাত না খেয়ে থাকবি? শেষে দেখবি মাঝ রাত্রিরে খিদে লাগিছে’।

আব্বার কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘একরাত না খেলে কিচ্ছু হবে না। কয়দিন তো খুব হুড়পাড় করে কাটালো। সবাই চলে যাওয়ায় খারাপ লাগতিছে মনে হয়’


খাওয়া শেষে মা ঘরে এসে আমার টেবিলের উপর বাটিতে করে বাড়িতে কোটা নতুন ধানের চিড়া আর খেঁজুরের পাটালি গুড় রেখে গেলো। গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখলো শরীর ভালো আছে কিনা! নতুন ধান ওঠার পরে আমাদের বাড়িতে গ্রামের আর সব গৃহস্ত বাড়ির মত চিড়া কোটা হয়। নতুন ধানের চিড়ার গন্ধে বাড়ির বাতাসটা ম ম করে। একেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে লুঙ্গির কোচড়ে করে অনেক গুলো চিড়া খেয়ে ফেলি। একমুঠ চিড়ার সাথে এক কামড় করে খেঁজুরের পাটালি গুড়। কিন্তু আজ চিড়া গুড় অচ্ছুৎ অবস্থায় টেবিলের উপর পড়ে রইলো। মাঝ রাতে দূর আকাশের তারারা একে একে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। একটা একটা করে সবাই ডুব দিতে লাগলো অন্ধকারের চাঁদরেএকসময় সাদা সাদা ফুটকি আঁকা আকাশ নামের নকশি কাঁথা পুরোটাই কালো হয়ে গেলো। এই সময় বাতাসটাও আরো বেশী ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘরের সামনের সিঁড়ির পাশে লাগানো হাস্নাহেনার গন্ধ ভেসে আসে ঘরে। ফুফু বলে হাস্না হেনার গন্ধে সাপ আসে ঘরে। তিনি আব্বাকে বলেন গাছ গুলো কেটে ফেলতে। আব্বা হাসেনআমি ফুফুকে কার্বলিক এসিডের বোতল দেখিয়ে বলি এটা থাকলে বাড়িতে সাপ আসে না। ফুফু বিশ্বাস করে না। ‘এটা কি বড় হুজুরের পানি পড়া নাকি যে এর  জন্য সাপ আসবে না!’  রাতে ঘুমিয়ে গেছি কখন তা নিজেও টের পাইনি। হাঁস মুরগির খোঁয়াড় থেকে লাল মোরগের কক্কর কো শোনা গেলো। আব্বার গলা খাঁকারির শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য সিঁড়িতে বসে ওযু করছেনতার মানে এখনো সুবহে সাদেক হয় নাই। সকাল হতে আরো অনেক বাকি। আমি পাশ ফিরে শুইলাম। রহিম অঘোরে ঘুমুচ্ছে। গায়ের লেপ সরে গেছে সে খেয়াল তার নেই। আজ রাতে খুব একটা কুয়াশা ছিলো না।  দ্বীপ্ত ভাইয়েরা এতক্ষণে খুলনা টাউনে পৌঁছে  যাওয়ার কথা। এত সকালে কি তারা কোন রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করছে নাকি ঢাকার বাসে উঠে পড়েছে!


লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ১৯

বিকেল পাঁচটার লঞ্চ ঘাটে এলো সাড়ে পাঁচটার পরে। সুর্য্য পশ্চিম আকাশে তখন হেলে পড়েছে। দিগন্ত জুড়ে লাল আবিরের ছড়াছড়ি। ঘাটে এসে পৌঁছেছি সাড়ে চারটার দিকে। পুরুষ বিশ্রামাগারে বসে আছি আমি বসেছি দ্বীপ্ত ভাইয়ার গা ঘেঁসে। চেনা গন্ধটাকে বুক ভরে নেয়ার চেষ্টা করছি। মিয়াভাইয়ের সুটকেস রহিম মাথায় করে নিয়ে এসেছে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যাকপ্যাকটা আমার কাঁধে চড়ে এলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া নিজের কাঁধে ঝুলিয়েছিলোআমাকে তো কিছুতেই নিতে দেবে না। আমি জোর করেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম।
               
মিয়াভাই রহিমকে সাথে নিয়ে আগে আগে অনেক দুর এগিয়ে হাটছিলেন। আমি আর দ্বীপ্ত ভাইয়া পাশাপাশি হাঁটছি। মনের ভিতর হাজার কথা আকুপাকু করছে। কিন্তু মুখের কথা হয়ে সেগুলো বের হচ্ছে না। রাস্তা নির্জন হলে দুজন দুজনের হাত ধরছি। আজ দ্বীপ্ত ভাইয়া বেশ সাবলীলভাবে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এলো। অথচ প্রথমদিন সাঁকো পার হওয়ার সময় সেকি কাঁপাকাঁপি। তার শরীরে কাঁপুনিতে পুরো বাঁশের সাঁকো দুলতে শুরু করলো। বাঁশের দুদিকে পা ঝুলিয়ে মাঝ সাঁকোয় সে বসে পড়লো। দোকানঘরের সামনে কয়েকজন লোক বসা ছিলো। শহুরে বাবুর কান্ডকারখানা দেখে তারা হেসে উঠলোতার করুন অবস্থা দেখে আমারো হাসি পেয়েছিলো। শেষে আমি তার হাত ধরে ওপারে নিয়ে যাই। মাফলারে মুখ ঢাকা ছিলো বলে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু সেই ফর্সা সুন্দর হাত ধরার পর থেকে এক অন্যরকম মুগ্ধতা শুরু হয়।

সাঁকোর কিছু আগে নতুন দাদির বাড়ি। নতুন দাদি বাড়ির মাটির প্রাচীরের গায়ে গোবরের ঘুটি লাগাচ্ছিলো শুকানোর জন্য। এই অবেলায় গোবর চটকাচ্ছে। কাজ ছাড়া নতুন দাদীকে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। এই ক্ষ্যাতের বেড়া বাঁধছে নয়তো নাতনীর হাত ধরে ছাগল গুলোকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষন সে গরুর জাবর কাটার মত পান চিবায়। নতুন দাদা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে নতুন দাদিকে খুব খেঁপাতো।  নতুন দাদি খুব হাসিখুশী একজন মানুষ ছিলো। কিন্তু দাদা মারা যাওয়ার পর অনেকটা মৌন হয়ে গেছে। আগের মত হাসির কোন কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি খায় না, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে গাঁয়ে হলুদে কাঁদামাটি করে না। গানে গলা মেলায় না। উঠতি মেয়েদের নাঁচে হারিয়ে দিতে চায় না। নতুন দাদির ছেলেটা গঞ্জের দোকান থেকে ভালোই আয় রোজগার করে। নতুন দাদি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। পানের রসে তার ঠোঁট টুকটুকে লাল হয়ে আছে। পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শহরের কুটুম বাড়ি যায়?

‘হ্যাঁ দাদী’।

‘আমাগে বাড়ি বসো। পান তামাক খেয়ে যাক’

‘না দাদী। আজ থাক। দেরী হয়ে যাবে। আর সে পান তামাক খায় না’।

পান তামাক না খেয়ে মানুষ কিভাবে বাঁচে এটা নদীর দাদীর কাছে এক মহা বিষ্ময়! আমরা এগিয়ে যাই। নতুন দাদি তার নাতনীকে ডাকতে থাকে। নাতনীর নাম রেখেছে তার মামারা শাকিলা আক্তারনতুন দাদি ডাকে তারাচান বানু বলে। মেয়ের নামের বিকৃতি নিয়ে পুত্রবধু কয়েকদিন কথা বলার চেষ্টা করেনি এমন নয়। কিন্তু নতুন দাদি কান দেয় নাই। নাতনি এসে নতুন দাদির আঁচলের খুঁটে বাঁধা পান সুপারি তার মুখে তুলে দেয়। নিজেও এক টুকরা গো ( সুপারি) মুখে পুরে ছোট দাঁত দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করে

বাড়ি থেকে বেরোনোর পর রাস্তায় দেখা হয় গফুর গাছির সাথে। সে গুড় নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। দ্বীপ্ত ভাইয়া তার দিকে হাত বাড়ালো। গফুর গাছি নিজের তেল চিটচিটে গামছায় হাত ঘষে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো। হ্যান্ডশেকের আরবি মোসাফাহ। গ্রামদেশে অনেকে মোসাফাহ করাকে সোয়াবের কাজ বলে মানে। গফুর গাছি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ঢাহায়  খাঁজুরের গুড়ের দর নাকি অনেক বেশি? শুনিছি সেহানে সের প্রতি পুঞ্চাশ ষাইট টাকা কইরে দর পাওয়া যায়। রাস্তা ঘাট সিরাম চিনা জানা নাই । জানা থাকলি একবার দুই কলসি গুড় বেঁচে আসতাম’

গাছির সরলতায় অন্য সময়ে দ্বীপ্ত ভাইয়া নিশ্চিত হাহা করে উঠত। আজ ঠোঁটে হালকা হাসি ফুঁটিয়ে বললো, ‘গফুর ভাই। ঢাকা শহর এখান থেকে অনেক দুর্। দুই কলস গুড়ের দামে তোমার আসা যাওয়ার খরচে লেগে যাবে। যদি কিছু মনে না করো তবে এটা রাখো’

দ্বীপ্ত ভাইয়া বেড়াতে আসার আগে অনেক কিছুই নতুন করে কিনে এনেছিলো। যদিও সেগুলো ব্যবহার করার দরকার হয় নাই। তার নতুন তোয়ালেটা বাড়িয়ে ধরেছেন গফুর গাছি্র সামনেগফুরের চোখে খুশির চকচকে ভাব। সে খুশী হয়েছে এটা তার চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে।

‘ নাকিছু মনে করবো ক্যান। আল্লার নবী গাঁয়ের বস্তর খুলে গরীব দুখীকে দিয়ে দেতো

বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা আর ফুফু বরাবরের মত কান্নাকাটি করলো। আব্বা ‘দেখে শুনে ভালোভাবে’ যেতে বললেন। মিয়াভাই  সবাইকে কদম বুচি করলেন। তাকে দেখে দ্বীপ্ত ভাইয়াও কদম বুচি করলেন।

মা বললেন, ‘থাক বাবা । সালাম করতে হবে না। দোয়া করি। অনেক বড় হও। আমাদের এখানে তো কয়েকদিন তোমার থাকা খাওয়ার অনেক সমস্যা হলো। আবার বেড়াতে আইসো’

মা ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। গ্রামীন টানে তিনি বেশ শুদ্ধ বাংলা বলেন মাঝে মাঝে। যদিও তাতে সাধু ভাষার শব্দের প্রাবল্য থাকে।

দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, ‘কষ্টের কথা কি বলছেন চাচীমা। এই কয়দিনে আমি আমার জীবনের সেরা সময়টা উপভোগ করলামআমার তো ইচ্ছে করছে সারা জীবনের জন্য এই গ্রামে থেকে যেতে’

মিয়াভাই বন্ধুকে ফোঁড়ন কেটে বললো, ‘মা দেখতো গ্রামে বিবাহ যোগ্যা কোন মেয়ে আছে কিনা। বিয়ে দিয়ে দ্বীপ্ত মিয়াকে ঘর জামাই হিসেবে রেখে যাই’

সবাই হেসে উঠলো। মিয়াভাই দ্বীপ্ত ভাইয়াকে তাড়া দিলো, ‘নে এবার বের হ। আসার সময় এমন ভাব নিলি যেন মনে হচ্ছিলো সুন্দরবনের মাঝখানে যাচ্ছিস। এটা সেটা কত কি কিনলি। তোর ব্যাগ থেকে মশারি বের হলেও আমি অবাক হতাম না’

দ্বীপ্ত ভাইয়া প্রতিবাদ করে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার আনা অনেক জিনিসের মধ্যে আছে মা ও ফুফুর জন্য ঢাকার জামদামি শাড়িসবাই বেড়াতে এসে প্রথমেই উপহার বের করে। আর দ্বীপ্ত ভাইয়া বের করলো যাওয়ার দিন সকালে। সবাই চমকে গেলো মা ও ফুফুর পরনে এখন সেই শাড়ী পরারহিমকে দিলো একটা বডি স্প্রে । সেই বডি স্প্রে রহিম এতটা মেখেছে যে সারা বাড়ি সুগন্ধময় হয়ে গেছে।


মা ফুফু আমাদের এগিয়ে দিতে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। যতক্ষন আমাদের দেখা যায় ততক্ষন তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন। এই অবস্থায় আমি পেছন ফিরিনা। দেখা যাবে মা। ফুফু শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছছেন। তখন আমারও কান্না পায়।


লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ১৮


‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে ...’

লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে মিয়াভাই এবং দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত নাড়ছেন। লঞ্চ একটু একটু করে বানিয়াখালী লঞ্চ টার্মিনাল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। লঞ্চ যান্ত্রিক চিৎকারে বিকেলের বাতাস ভারী করে তুললোএকরাশ কালো ধোঁয়া আকাশের দিকে ছুটে গেলোআকাশ ছুঁতে ব্যর্থ হয়ে সেই ধোঁয়া মনের দুঃখে বাতাসে বিলীন হয়ে গেলো। ঘাটে দাঁড়িয়ে রহিম আমি দুজনেই হাত নাড়ছি। রহিম মর্জিনার সাবান দিয়ে কেচে দেয়া লাল শার্টটি পরে এসেছে। তার মুখে উপচে পড়া হাসি। আমার হাত খানাই শুধু নড়ছে। মুখে বিষাদের ছায়া নাকি কালো ধোঁয়ার আভা! বুকটা আমার ছিড়ে যাচ্ছে। আমার মুখের হাসিটুকু কি চলে যাচ্ছে এই লঞ্চে করে ?

কয়েকদিনের ব্যস্ত সময়ে আমি অনেক কিছু ভূলে ছিলামপড়ালেখা মাথায় উঠেছেমায়ের বকুনি শুনে সন্ধ্যার কিছু পরে নিজের ঘরে পড়তে বসেছি। কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে! রহিম আমার ঘরের ওপাশের চৌকি খাঁটে ঘুমায়। সে দোকানে গেছে কেরোসিন তেল কিনতে। গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসে নাইকয়রা থানা সদরে অবশ্য বিদ্যুৎ আছে। আমি প্রথম বিজলি বাতির আলো দেখি কয়রা থানা সদরে ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে। এখনো মধ্য যুগের মত ‘কিরাসিন’ এর কুপি বাতিই আমাদের ভরসা। কেরোসিনের বাতিকে আমরা বলি ‘টেমি’

দরজায় ঠুকঠুক শব্দ শুনে আমি ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলামদ্বীপ্ত ভাইয়ার কথাই ভাবছিলাম। মিয়াভাই ফিরে আসার পর আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। মিয়াভাই যেন মুল ভিলেন। সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে কেন থাকতে হবে! কিন্তু আমার ঘরে কে নক করে আসবে ! সবাই এসে দড়াম করে দরজা খোলে। ছোট হওয়ার এই এক জ্বালা । প্রাইভেসি বলে কিছুই থাকে না। আমি বললাম, কে ?
দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, ‘আমি দ্বীপ্ত’

‘ভেতরে আসছেন না কেন ভাইয়া? ভেতরে আসেন’

আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি এরই মধ্যে দ্বীপ্ত ভাইয়া রুমে ঢুকে ভেজানো দরজা আবার ভিজিয়ে দিয়ে দরজার কপাটে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়ালেন। নি:শব্দে আমার দিকে দু হাত বাড়িয়ে দিলেনতার চোখের চাহনি আমাকে বাঁধনহারা করে ফেললো। আমি তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমাদের তৃষ্ণার্ত অধরে প্রেমের সুধাবারি বর্ষিত হতে থাকলোদ্বীপ্ত ভাইয়া ভেতরে ভেতরে আমাকে এতটা মিস করেছে, ফিল করছে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বাহিরে তিনি সব সময় সবার সাথে সহজ সরল প্রাঞ্জল ব্যবহার করছেন

দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখের মনি কাঁপছে।

‘কি হয়েছে জান?

‘এত দ্রুত সময় ফুরিয়ে গেলো শুভ্র! আগামীকাল আমি চলে যাচ্ছি’

আমি হঠাৎ চমকে উঠলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া যে বেড়াতে এসেছে, দুদিন বাদে চলে যাবে এই কথাই তো আমি ভুলে গেছিলাম। আমি তার গলা জড়িয়ে ধরলাম। আস্তে আস্তে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,

‘এত দ্রুত যাবে কেন ? আমি যেতে দিলে তো! কাল তোমাকে কিছুতেই যেতে দেবো না।’

‘আমারও যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ না হোক কাল যেতেই হবে। তাছাড়া সজলই তাড়াহুড়া করছে’

আমি আর কিছু বলার খুঁজে পেলাম না। দুচোখ কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে এলো। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার বুকে মাথা রাখলাম। শব্দ করে কাঁদতে পারছি না। চাঁপা কান্নার উচ্ছ্বাসে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছি।  আমার মাথায় কয়েক ফোঁটা গরম জল ঝরে পড়লো। আমি মুখ তুলে দেখি দ্বীপ্ত ভাইয়াও নিরবে চোখের জল ফেলছেন। তার হাতের আঙুলগুলো আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো। আমিও একই ভাবে তার চোখের পানি মুছে দিলাম। তার ঠোঁট নেমে এলো আমার ঠোঁটে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের আগে হয়তো এটাই আমাদের শেষ চুমু।

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটে সেই আকাশী নীল শার্ট। দ্বীপ্ত ভাইয়া বললো, ‘শুভ্র বাবু, তুমি আমাকে কি দেবে?

কি দেবো ! আমি দেওয়ার মত কিছুই খুঁজে পেলাম না। ঘরের চারদিকে তাকাই। কি দিবো আমি!

‘তোমাকে দেওয়ার মত কি আছে আমার? কি দেবো আমি!’

‘শুভ্র, তুমি আমাকে আমার জীবনের সেরা কিছু মুহুর্ত দিয়েছ। আমার খুব ইচ্ছে করে আমার ভালোবাসার কথা চিৎকার করে জানিয়ে দেইপুব বিলের মাঝে, শালিক খালির নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি স্মৃতি হিসেবে তোমার ব্যবহার করা এই গামছাটা নিয়ে যাবো। দেবে আমাকে?

‘তুমি আমাকে সাথে নাও। আমি ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করবো । আর শুধু গামছা কেন, আমার সব কিছুই তোমার সব কিছু নাও তুমি’

‘পাগল ছেলে একটা’

তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রহিমের গলার স্বর শুনে হাত সরিয়ে নিলেন। শব্দ করে রহিম দরজা খুললো।  

‘খবর শুনিছো ছোড ভাই?’

‘কিসের খবর?’

‘ম্যাভাই কাইলকে চলে যাবে। আমাগে তো আগোয় দিতি যাতি হবে। তাড়াতাড়ি করে খায়ে শুয়ে পত্তি হবে’

‘তুই আছিস তোর শোয়া নিয়ে। যাবে তো বিকেলের লঞ্চে। তাতে তোর এখনি ঘুমানো লাগবে!’

‘ওহ। বৈকালে যাবে। আমি ভাবলাম বিহানবেলার লঞ্চে করে যাবে’।

রহিম বকা খেয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। যাওয়ার সময় দরজা হাট করে খুলে রেখে গেছে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে আছি। মিনিট পাঁচেক বাদে খোলা দরজায় মিয়াভাইয়ের মুখ দেখা গেলো। আমার বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লেন।

‘শুভ্র, পড়াশোনা করছিস তো। দ্বীপ্ত’র কাছ থেকে অংক দেখিয়ে নিলে পারতি। অংকে দ্বীপ্ত সবসময় ৯৫% করে মার্ক পেয়ে এসেছে’


গার্জেনদের এই এক সমস্যা। বাড়িতে  লেখাপড়া জানা কেউ এলে বলে অমুকের কাছ থেকে অংক-ইংরেজি দেখে নে।


লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ১৭

           চলনা ঘুরে আসি অজানাতে , যেখানে নদী এসে থেমে গেছে...

নদীর বুকে ঘোলা পানি কেটে ভটভট শব্দে ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। বানিয়াখালি ফরেস্ট ক্যাম্প পেরিয়ে এসেছি একটু আগে। নদীর ডানপশে সুন্দরবন, বামপাশে লোকালয়। নদীর পাড়ের মেয়ে বধুরা নেটের জাল নিয়ে কোমর পানিতে চিংড়ীর পোনা ধরতে টানা দিচ্ছে। একজায়গায় দেখলাম ছোট্ট নৌকায় বুড়ো বুড়ি বসে কাঁকড়া ধরছে। বুড়ি হাল ধরে আছে। বুড় দড়িতে বাঁধ আঁধার পানিতে ছুড়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে সুন্দরবনে জীবিকার অন্বেষনে যাওয়া বাওয়াল , মৌয়াল, জেলেদের ফিরে আসা নৌকা দেখা যাচ্ছে। তারা জোরে জোরে বৈঠা বাইছে। খুলনা গামী একটা দোতলা লঞ্চ আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো। পানির ঢেউয়ে ট্রলার খানা দুলতে লাগলো

ট্রলারে যাত্রী গুটিকয়েক মানুষ। হাল ধরে বসে আছে ছাকা মাঝি। ছাকার নাম ছাকিম। কিন্তু গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এটা ‘ছাকা’ হয়ে গেছে, যেমন আজিজুল হয়ে যায় ‘আইজুল’, বাকের হয় ‘বাকা’ছাকার বাপ রমজান মাঝি খেয়াঘাটে মানুষ পারাপার করত। শক্ত সামর্থ্য লোকটা গত অগ্রহায়নে হঠাৎ করে মারা গেলো। ছাকা কিছু টাকা জমিয়ে ট্রলার খানা বানিয়েছে কয়েক মাস আগে। ভাড়ায় মহাজনদের মাল টানে এই হাট  থেকে ওই হাটে। মিয়াভাইয়ের  বয়সী। ভাইয়া ট্রলার খুঁজছে শুনে সে নিজে এসে বললো, ‘জালাল ভাই আমার টলার থাকতি ভাড়া কত্তি যাবা ক্যান। আমিই কাইলকে তুমাগে নিয়ে যাবো বাঁদা দেখাতি’ভাড়া নেয়ার ব্যাপারে সে কিছুতে রাজি হলো না।

একবার ওদের পুবের বিলের দুই বিঘে জমি নিয়ে সরদার বাড়ির মজিবর সরদারের ঝামেলা হয়। মজিবর সরদার ভুয়া কাগজ বানিয়ে গরীবের শেষ সম্বল জমিটুকু গাপ করে দেয়ার ফন্দি আঁটে। ছাকার বাপ গরীব ঘাটের মাঝি, লেখাপড়া জানে না টিপসই ভরসা। অফিস আদালত কোট কাচারি করবে কিভাবে।  আব্বা হাট থেকে সদাই নিয়ে একা ফিরছিলো। মাঝি বৈঠা  টানে কিন্তু নৌকা এগোয় না। আব্বা মাঝিকে শুধায়, ‘শরীর খারাপ?

মাঝি মাথা নাড়ায়। ‘শরীর খারাপ না। মনডা বড় ব্যাজার’বাপ দাদার শেষ সম্বল দুবিঘে জমি, তাও ধরে রাখতে পারতিছিনেপোলাডার জন্য কিছুই রাইখে যাতি পারতিছিনেসারাদিনে খেয়াপারের টাকা দিয়ে সংসারই চালাতে পারিনেমামলা মোকদ্দমা চালাবো কি দিয়ে!’

আব্বা রমজান মাঝিকে শুধু টাকা দিয়ে সাহায্য করেনি উপরন্তু নিয়মিত কোর্টে যেত মাঝির সাথে। এটা নিয়ে সর্দার বাড়ির লোকের সাথে আমাদের ঝামেলা হয়। বিল থেকে একদিন আমাদের একটা খাসী ছাগল হাওয়া হয়ে গেলো।



ট্রলারের ছাদে বসেছে দ্বীপ্ত ভাইয়া, মিয়াভাই ও মিয়াভাইয়ের স্কুলের বন্ধু রবি ভাই, খোকন ভাই, গোলাপ ভাই। রবি ভাই বখাটে পনা স্বভাবের কারণে স্কুলে পড়া শেষ করতে পারে নাই। তার বাপ তাকে বিয়ে দিয়ে গঞ্জের হাটে নিজেদের দোকানে বসিয়ে দিয়েছে। রবি ভাইয়ের ছেলেই এখন প্রাইমারিতে পড়ে। খোকন ভাইয়া কলেজ পর্যন্ত পড়েছে। দুইবার পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেন নি। উদাস কবি টাইপের মানুষ। গানের গলা আছে। বাউল গানে আসর মাতাতে তার জুড়ি আমাদের গ্রামে আর দ্বিতীয়টি নেই। এই গানের সুত্র ধরেই পাশের গ্রামে অখিল সাহার বাড়িতে তার নিয়মিত যাতায়াত । অখিল সাহার মেয়ে কবিতা রানী সাহার সাথে খোকন ভাইয়ের প্রেমের গল্প সারা গ্রামে চাউর আছে। মেজ দাদি বলে, ‘গ্রামে কি মোচলমানের মাইয়ার আকাল পড়ছে যে মালাউনের মাইয়ার লগে সাদি করতে হবে’

গোলাপ ভাই পড়াশোনা করছে। খুলনা বিএল কলেজে পড়ে বাংলা সাহিত্যে। দ্বীপ্ত ভাইয়া তাদের সাথে মিলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সেই রাতের পর থেকে আমরা দুজন আর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সময় এত দ্রুত কেটে যাচ্ছে যে কিছুই টের পাই নিআজ ট্রলারে আমি তার গা ঘেঁষে বসলাম। দেখলাম তিনি চুপচাপ। সরে এলাম।

ট্রলারের গলুইয়ে বসেছি আমি এবং রহিম । ট্রলার এখন মূল নদী ছেড়ে শাখা নদী দিয়ে  বেশ ভেতরে চলে এসেছে। নদীর দুপাশেই সুন্দরবন। গাছের সারি দেখলে মনে হয় মালীর হাতে সযতনে লাগানো গাছের বাগান। গেওয়া, গরান, ধুন্দল, পশুর, বাইন, সুন্দরী, কেওড়া গাছের সারি। কোথাও ঘন গোলপাতা বন। গোলপাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে বাঘ। আব্বা পইপই করে বলে দিছে যেন সুন্দরবনের বেশী গভীরে না যাই। বাঘের ভয়ে নয়ডাকাতের ভয়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ডাকাতের উৎপাত অনেক বেশী। সুন্দরবন হচ্ছে ডাকাতদের অভয়ারন্য।

সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য হচ্ছে বিশুদ্ধ এবং নির্মল। এই অপরূপ রূপের বর্ননা ভাষায় বর্ননা করা সম্ভব নয়। শুধু দুচোখ ভরে উপভোগ করা যায়। বনের মাঝে শুনশান প্রশান্তিময় পরিবেশ। সেই নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ন করে ভটভট শব্দে ট্রলার এগিয়ে চলেছেনীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ। সাদা বকের দল তার নিচ দিয়ে উড়ে গেলো। গাছের ডালে বসা মদন টাক পাখিটি ঝিমুচ্ছে। তার পাশের ডালে উড়ে এসে বসলো একটি বন মুরগী। মদনটাক একটু মাথা উচু করে দেখে আবার ঘুমিয়ে গেলো। বনমুরগী টি কোকর কো করে ডাকতে লাগলোনিচের থেকে বনমোরগের পাল্টা ডাক শোনা গেলো আমি দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না। মুরগিটা সেদিকেই উড়ে গেলো। বনমুরগী উড়তে পারেএরা কক মুরগীর মত স্লিম হয়। রহিমের ডাকে নদীর দিকে ফিরলাম। পানির উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে সাঁতরে পার হচ্ছে কি একটা সাপ। রহিম বললো, ‘দেবো নাকি বাঁশের লগি দিয়ে একটা বাড়ি!’

আজব হাতে লাঠি থাকলেই বাড়ি মারতে হবে! খোকন ভাই ভাটিয়ালি সুর ভাসিয়ে দিলো বাতাসে,     

‘কে যায়রে ভাটির গাঙ বাইয়া, আমার ভাইজানরে কইয়ো ....’

গান শেষ হলো বান্দরের চেঁচামেচিতে। কেওড়া গাছের ডালে ঝুলে বুড়ো, ধেড়ে, কচি, জোয়ান বাঁদরের দল চিৎকার করছে। খুব সম্ভবত তাদের মধ্যে কোন কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ছাঁকা ভাই মিয়াভাইকে জিগাইলো সামনে যাবে কিনা ? সামনে একটু রিস্ক আছে। দুইদিন আগে কোহিনুর ডাকাতের দল দুই জেলেকে তুলে নিয়ে গেছে জোড়া খালের মাথা থেকে। বিশ হাজার টাকা মুক্তিপন চেয়েছে মহাজনের কাছে। মিয়াভাই  ট্রলার ঘোরানোর নির্দেশ দিলেন।


দ্বীপ্ত ভাইয়া বললেন, ‘এত দ্রুত ফিরে যাবো?

মিয়াভাই: ‘গাছপালা আর কত দেখবি! বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়ে বাকিটা দেখে নিস’।

দ্বীপ্ত: ‘তুই একটা হামবাগ। ন্যাচারালি দেখার মজাই বুঝলি না। বাঘ হরিন কুমির কিছুই তো দেখলাম না’

খোকন ভাই : ‘বাঘ কুমিরকে চিঠি না দিয়ে এলে কি তারা দেখা করে!’

ট্রলার ফিরতি পথ ধরেছে। গোলপাতা বন পার হবার আগেই একটা হরিন শাবক কে দেখা গেলো। আমরা সব হইহই করে উঠলাম। বাচ্চাটা থমকে দাঁড়ালো। তার মা ছুটে এলো। তারপর সে মায়ের সাথে ছুটে গেলো বনের ভেতর। হরিন দেখার আনন্দ আমাদের চোখে মুখে। কিছু মানুষের উপস্থিতি, কিছু প্রানী আমাদের মনে অনাবিল প্রশান্তি এনে দেয়

বাড়ি ফিরে আসতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। দুপুরে বাড়িতে খাবার কথা ছিলো। মা রান্না করে পথ চেয়ে বসে আছেন। ফুফু বলেন, ‘বাঁদায় গেলি তা একটা হরিন ধরে আনলি না ক্যান। পুষতাম’


আব্বা খেয়ে নিয়েছেন। আমরা চারজন খেতে বসলামপারসে মাছ ভাজা, ভেটকি মাছ ভুনা, বাগদা চিংড়ির কোর্মা। আব্বা বড় বড় বাগদা মাছ কিনে এনেছেদ্বীপ্ত ভাইয়ার পাতে ফুফু বেশ কয়েকটা তুলে দিলো। আমি চিংড়ি খেতে পারিনা। গা ঘিন ঘিন করে। এটা জানা সত্বেও দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার প্লেটে একটা বাগদা চিংড়ি তুলে দিলো। আমি চুপ করে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলোএবার আমি কি করি সবাই সেই মজা দেখতে চাচ্ছে