blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ০১

৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৪। ঢাকা বিমান বন্দর।
সন্ধ্যা ৭ টা ৪৩ বাজে। দীর্ঘক্ষণ বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে হাঁটাহাটি করছি। এমনি সময়ে সাউন্ডবক্সে নারীকন্ঠের সুললিত কন্ঠস্বর আমার বুকের কাঁপন বাঁড়িয়ে দিলো। নিজের বুকের ধুকপুকুনি যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছি। বিমানে চড়ার সুযোগ আমার কখনও হয় নাই। আর আজ আমি কোথাও যাচ্ছি না। যাওয়ার খুব বেশী জায়গা আমার অবশিষ্ট নেই। বিশাল এই পৃথিবী হঠাৎ করে আমার জন্য ছোট হয়ে গেলো কেমন করে তা আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি একে একে আশপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। আজ দীপ্ত ভাইয়া আসছেন। দীপ্ত ভাইয়া! সেই দ্বীপ্ত ভাইয়া। কৈশোরে যে ছিলো আমার কাছে এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। জানা অজানা নানা তথ্যে সে আমার জ্ঞানকে করেছিলো সমৃদ্ধ। জ্ঞান পিপাসাকে দিয়েছিলো বাড়িয়ে। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্বীপ্ত ভাইয়ার সাথে আমার যোগাযোগ নেই বছর দশেক হবেমাস তিনেক আগে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলাম। নাম দেখে চেনা চেনা লাগে। প্রোফাইল পিকচারে সাম্প্রতিক একটা ছবি। মুখের আদলটাও অনেক পরিচিত। কিন্তু তাতে কিছু মাংস জমে আগের সেই লাস্যময় ভাবটা অনেকটা কমে গেছে। তবে বয়সের তুলনায় এখনও সে অনেক তরুন আছে। বয়স তার কতই হবে! সাইত্রিশ কি আটত্রিশ। ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। একদিন জানালেন তিনি দেশে আসছেন। আমি যেন রিসিভ করতে যাই। সপরিবারে নিউ ইয়র্ক থেকে ঊড়ে এলেন তিনি। ধীরে ধীরে যাত্রীরা লাগেজ ঠেলে বেরিয়ে আসছেন। আমি যাত্রী বহির্গমন পথের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

বামহাত বুকের উপর একবার বুলিয়ে নিলাম। হার্টবিটটাকে পারলে চেপে ধরে থামাতাম। এত জোরে বিট দেয়ার কি আছে! এখন কি আর সেই কৈশোরের মত নার্ভাস হওয়ার দিন আছে!  ট্রলি ঠেলে এগিয়ে আসছেন দীপ্ত ভাইয়া। একটু স্বাস্থ্য বেড়েছে এই যা কিন্তু ঠিক আগের মতই আছেন। ২০০০ সালে তাকে প্রথম যেমন দেখেছিলাম আজো যেন সেরকই মনে হচ্ছে। হালকা গড়নের এক তরুন মিয়াভাইয়ের হাত ধরে লঞ্চ থেকে নামলেন বানিয়াখালি লঞ্চঘাটে। শীতের রাতে কুয়াশাঁ জমে সব পিছল হয়ে ছিলো। পল্টুনে আমি আর রহিম দাঁড়িয়ে ছিলাম। রহিম দৌঁড়ে গিয়ে তাদের ব্যাগ ব্যাগেজ কাঁধে তুলে নিলো। আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলামভাইয়া তার বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “দ্বীপ্ত, এ হচ্ছে শুভ্র। আমার ছোট ভাই।” দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন।

দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিকে আমি তাকিয়ে আছি। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি হাত নাড়ছেন। আমিও হাত নাড়ালাম। তার পেছনে একটা মেয়ে হেঁটে আসছে ফুটফুটে বাচ্চার হাত ধরে কণা ভাবির চোখে আনন্দের ঝিলিক। খুব সম্ভবত অনেক দিন বাদে দেশে আশায় মনে বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস বোধ করছেন। অনেক দিন পরে দীপ্ত ভাইয়ের সাথে দেখা। এরই মধ্যে দশ বছর পেরিয়ে গেছেআমার তো মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। কিছুটা মুটিয়ে যাওয়ায় গোলগাল চেহারা হয়েছে দ্বীপ্ত ভাইয়ারবয়সের হালকা ছাপ পড়েছে কিন্তু চেহারা সেই আগের মতই আছে। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। সেই চোখ, চিরচেনা চোখ, যে চোখে আমি দেখিয়েছিলাম অন্য এক জগত।

আশপাশে অনেক মানুষের ভিড় ভিড় ভাট্টা আজকাল আর ভালো লাগে না। সবাই এসেছে অভ্যাগতদের রিসিভ করতে। কারো ছেলে, কারো স্বামী। প্রত্যেকের চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দের ঢেউ। আবার কেউ এসেছে অফিশিয়ালি রিসিভ করতে। তাদের হাতে প্লাকার্ড। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা প্লাকার্ড হাতে কিছুটা নার্ভাস ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে প্লাকার্ড দেখে বুঝলাম জ্যাসন ওয়াকার নামের কাউকে রিসিভ করতে এসেছে। কিছু দূরে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক গোছা রজনীগন্ধা। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ এর কাছাকাছি। ফুলটুল আমার কিছু একটা আনা উচিত কিনা এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। দেখা যায় ছোট খাট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়।

দীপ্ত ভাইয়া কখন যে আমার সামনে এসে গেছে তা আমি মোটেও আমি টেরই পাইনি। কেমন আছিস? সেই চেনা কন্ঠস্বর। গত কয়েকদিনে স্কাইপে, ফোনে শুনেছি। কিন্তু আজ সরাসরি শোনার পর বুকের ভেতরটা মোঁচড় দিয়ে উঠলো। কিছু একটা বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে উঠে গলায় এসে বেঁধে গেলো। কান্না! না, কান্না নয়। কাঁদতে আমি বহুদিন ভূলে গেছি। বুকের ভেতর কান্না জমে জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছিলো দ্বীপ্ত ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি সেই এক বর্ষা ভেজা শেষ চৈত্রের সন্ধ্যায় যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু অচেনা একটা লজ্জা আমাকে অনড় করে দিলো। আমি বোবা চাহনিতে সেই চেনা চোখের দিকে চেয়ে থাকলামলাগেজটা পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই চেনা স্পর্শ চেনা আলিঙ্গন। কিন্তু ভাবীর সামনে আমার আড়ষ্ঠ ভাব কিছুতেই কাটছিলো নাশুধু মনে হচ্ছিলো আমার শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হচ্ছে নাতো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যে ঘামার সুযোগ নেই সেটা মাথায় আসছে না।

আলিঙ্গন দীর্ঘ হলো না। কোলাকুলি সেরে দীপ্ত ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস শুভ্র?

মাথা নেড়ে জানালাম, “ভালো আছি” সে কেমন আছে সেটা আর জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না।

‘চশমা নিয়েছিস কবে? মাথার চুলগুলো কোথায়? সামনে এত ফাঁকা কেন? হেয়ার ট্রিটমেন্ট করাস না কেনবাড়ীর খবর কি? সজল এর কি খবর?

একরাশ প্রশ্ন করে গেলেন। যদিও এর  অধিকাংশ উত্তর তিনি জানেন। ভাইয়ার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট থেকেই সে আমাকে খুঁজে বের করেছে। ভাইয়ার খবর সে জানবেনা এটা কিভাবে হয়! ফেসবুকের এই যুগে আমরা অনেক দূরে থেকেও কাছে থাকি। আবার কাছের মানুষ থেকে নিজের অজান্তে দূরে থাকি ফেসবুক যেমন দেয় তেমনি অনেক কিছু কেড়ে নেয়। ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই ভাবী মুখ খুললেন।

‘হু হুহ! শুভ্র সাহেব। আপনি কি শুধু একজনকেই রিসিভ করতে এসেছেন। তবে কি আমরা ফিরে যাবো? আমাদের দিকে একটু তাকান প্লিজ। আপনার নাম অনেক শুনেছি। এবার কথা বলে ধন্য হই।

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আসলেই তো। একবার ভদ্রতা করেও ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করা হয় নাই। ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। সে হাসিতে প্রশ্রয়ের ছাঁয়া। বোঝা যাচ্ছে ভাবী মোটেও রাশভারী কেউ নয়। ভাবীকে ছবিতে দেখেছি। দীপ্ত ভাইয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। সংগত কারনেই যাইনি। সরাসরি ভাবীকে এই প্রথম দেখলাম। ছবির থেকেও ভাবী অনেক সুন্দরী। ভাবী আমারই বয়সী। বছর খানেকের বড় হতে পারে। তাদের যখন বিয়ে হয় আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি আর ভাবী এইচএসসি পাশ করেছেন সেই বছর। বিয়ের দশ বছর পর বাঙালী বধুরা মুটিয়ে যায়। মনে হয় একটা মাংসের স্তুপ। দুই বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারবে না এমন তার সাইজ ভাবীকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ফিগার সচেতন এখনো চেহারায় লাবন্য ঝরছে। সিনেমায় নামলে শাবনুর মৌসুমিরা ফ্লপ সাইডে পড়ে যাবে একথা আমি হলপ করে বলতে পারি। ভাবীর কন্ঠস্বরের আন্তরিকতা আমাকে সহজ করে দিলোহালকা কথা বার্তাতেই ভাবীর সাথে ফ্রি হয়ে গেলাম। অথচ কাল রাত থেকে কতই না টেনশান করলাম। ভেবেছিলাম আমি ভাবীর সাথে সেভাবে কথা বলতে পারবো না।


-----------------------------------------------------------------