blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ২১

পুরো ১০ দিন আমি স্কুলে যাই না। চুপিচুপি স্কুলে ঢোকার আগে হেডস্যারের সাথে দেখা।

‘কি ব্যাপার, শুভ্র সাহেব নাকি! তা এদিকে কি মনে করে! পথ ভুল করে আজ এদিকে এলেন নাকি!’

আমি নিরুত্তর হয়ে স্যারের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যার আমাদের সবসময় মাথা উচু করে চলার পরামর্শ দেন। কিন্তু তার সামনে এলে আমাদের উঁচু মাথা নিচু হয়ে যায়। বিনয়ে নয় ভয়ে। স্যার মহা তেজী। অন্য স্যারেরাও স্যারকে ভয় পায়, সমঝে চলে। ভয় পান না  শুধু সুশীল স্যার সুশীল স্যার যে হেডস্যারেরও স্যার। স্কুলের বড় ভাইয়ারা আড়ালে হেডস্যারকে বলে টাইগার স্যার তিনি চিৎকার করলে নাকি বাঘের হালুম ডাকের মত শোনা যায়।

ক্লাসে ঢুকে আমার চিরাচরিয়ত স্বভাব অনুযায়ী বামপাশের দ্বিতীয় বেঞ্চের ডান কোনার সিটে বসলাম। ক্লাসের তিন সারি বেঞ্চের দুই সারি ছেলেদের। এক সারি মেয়েদেরমেয়েদের সারিতে প্রথম বেঞ্চে বসা সুস্মিতা গলা তুলে বললো, ‘কিরে দোস্ত, কোথায় ডুব মেরেছিলি আজ কয়েকদিন। খুব ডেটিং করলি না?

ডেটিং এর কথা শুনে ক্লাসের সবাই মনযোগ আকর্ষিত হলো আমাদের দিকে। স্কুল লাইফে ডেটিং এক নিষিদ্ধ জিনিসের নাম। সুস্মিতা সবাইকে বানিয়ে বানিয়ে আমার নামে প্রেমের গল্প শুনিয়ে দিলো। আমি নাকি কোন মেয়ের সাথে তিন মাস চুটিয়ে প্রেম করছি। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কাছের বন্ধুদের অনেকের কোনায় সুক্ষ ঈর্ষা, আবার কারো চোখে সলাজ অভিনন্দনের ভাষা।

আমি ক্লান্ত স্বরে সুস্মিতাকে বললাম, ‘দোস্ত তুই উপন্যাস লেখা ধর। ভালই মার্কেট পাবি’।

স্কুলে শেষে বাড়ির পথ ধরলাম। সরকার পুকুর পাড়ে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আমাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয় ইটের তৈরি হাউজে। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই তারা পানীয় জলের চাহিদা মেটায় এই পুকুর থেকে। পুকুরের পাড় অনেক উঁচু। বৃষ্টি, বন্যায় আশপাশের বিল পুকুর তলিয়ে গিয়ে একাকার হয়ে যায় কিন্তু উঁচু পাড়ের কল্যাণে সরকার পুকুর তলায় না। এই পুকুরে জনসাধারণের গোসল করা নিষিদ্ধ। ঘাসের বুকে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নি:সঙ্গ এক পাখি উড়ে যাচ্ছেডানায় তার শেষ বিকেলের রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। কাদের একটা বউ পানি নিতে পুকুরে নেমেছে। আমাকে দেখে ঘোমটা দিলো। নতুন বউ হবে। তা না হলে এত জড়সড় হত না। পুকুর পাড়ে বসে থাকা দৃষ্টিকটু দেখায়। আমি হাটা শুরু করলাম। মদ্যির ডাঙার এসে থমকে দাঁড়ালাম। সেদিনের ছাই গুলো আমাদের বনভোজনের স্মৃতি হয়ে পড়ে আছেখেঁজুর গাছের আড়ালে দেখা গেলো গফুর গাছিকে। তোয়ালে খানা চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। ইষৎ হলুদাভ তোয়ালের উপর বড় করে কয়েকটা গোলাপ ফুল আঁকা।

শুকনো পাতা মাড়িয়ে আমি হেঁটে চলি। আমার সাথে একরাশ স্মৃতি হয়ে হেঁটে চলে দ্বীপ্ত ভাইয়া। এক শহুরে যুবক, যার জামার কাটিং, চুলের স্টাইল আমাকে বিমুগ্ধ করেছিলো। সব কিছু ছাড়িয়ে তার ব্যক্তিত্ব আমাকে এখনো মুগ্ধ করে রেখেছে। অন্যকে অনুকরন করার, অন্যের মত হওয়ার এক বিশাল প্রবনতা কাজ করে কৈশোরে।

রাস্তার বুকে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগিয়ে আসছে সবুরসবুর জন্ম থেকে বোবা এবং পঙ্গু। বাপমায়ের কোল জুড়ে আসা প্রথম সন্তান। সবুর যেদিন বসা শিখলো সেদিন বাবা মায়ের কি আনন্দ। সবুরের দাদি জুম্মা ঘরে গিয়ে বাড়ির বড় মোরগের রান্না করা মাংস দিয়ে গালে ভাত দিলো। মাংসের ঝালে সবুরের কচি গালে উত্তাপ আনে। সে কেঁদে দেয়। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে। দাদি শাড়ীর আঁচলে মুখ মুছে দেয়। ছেলের বয়স দুই পেরিয়ে যায়, তিন পেরিয়ে যায় তবু সবুর হাটা শেখে না। বাবা মা সবর করে। হুজুরের পানিপড়া, কবিরাজের তাবিজ কত কিছুই করলো।  একসময় তারা হাল ছেড়ে দিলোপরে তার দুটি বোন একটি ভাই জন্মে। অভাবের সংসারে  লুলা গুঙ্গা ছেলেটার প্রতি আর সেভাবে লক্ষ্য করে না। মুখের লালা চোয়ালে লেপ্টে যায়। তাতে ধুলোর কালো আস্তরন পড়ে। দাদি মাঝে মাঝে  বল সাবান দিয়ে ভালো করে ঘসে মেজে গোছল করিয়ে দেয়। কিন্তু বিকেলে দেখা যাবে আবার সেই ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

মাটিতে ঘসে ঘসে সে অনেক দূর চলে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম , সবুর কই যাবি ?, সবুর বয়সে আমার থেকেও বড়। কিন্তু অপুষ্ট শরীরে তাকে ১০ বছরের ছেলে মনে হয়। গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তাকে পাগল বলে ডাকে। সবুর হাতের বাঁকা আঙুল গুলো সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। বোবা মুখে কথা ফোঁটে না। আউ আউ শব্দ হয়। মুখের লালা ঝরে পড়ে মাটিতে। আমি তাকে বললাম, বাড়ি যা। সে কি বুঝে হাসির মত শব্দ করে। উপরে নিচে মাথা ঝাকায় কয়েকবার্। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিলে সবুরের দাদির মত কাউকে মাঠে চরা গরুর গোবর কুড়াতে দেখলাম। আমি গলা চড়িয়ে তাকে ডাকলাম। সবুরের দাদিই ছিলো। সে বিরক্ত মুখে  গোবর মাখা হাতে এক চড় বসিয়ে  দিলো সবুরের পিঠে। আমি বললাম, মাইরো না। ও কি আর বোঝে!

‘মারি কি আর সাধে বাপ। রাস্তার ধারে কত পইর আছে। পইড়ে ডুবে মরলি কিডা দেইখতো। আমি ঘুটে নুড়ি বানানির জন্যি এক ঝুড়ি গবর কুড়োতে আলাম। বাড়িতে ওর মা ছিলো। সে এট্টু দেখে রাখলি তো পাত্ত। গুঙ্গা ছেইলে বলে মা নিজির হাতে ছাবাল ডারে মৃত্যুর দিকি ঠেইলে দেবে! ইরাম ডাইনি মা আমি এই জীবনে আর দেই নি’

অদৃশ্য পুত্র বধুর উদ্দেশ্যে গজগজ করতে করতে সবুরকে বাড়ির দিকে টানতে থাকে।  সবুর উল্টো দিকে টানে। সে উল্টো পথে কোন দিকে যেতে চায়! তার কি ধারণা উল্টোপথে তার এই জীবন থেকে মুক্তির দুয়ার খোলা  আছে?


আমি একটা মহা গাধা। আমাকে উত্তমরূপে থাপড়ানো উচিত। দ্বীপ্ত ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানাটা রেখে দিলে আমি তো চিঠি লিখতে পারতামদ্বীপ্ত ভাইয়া তো আমাদের বাড়ির ঠিকানা সব জানে আর না জানলেও মিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সে কি একটা চিঠি দিতে পারে না!


-----------------------------------------------------------------