blogger widgets
শুভ্র ভাই এর লেখালেখির জগতে স্বাগতম! Welcome!

লাইফ উইদাউট লাভ - পর্বঃ ১৬

পরের দিন সকালে আমরা সবাই জড়ো হয়েছি মধ্যির ডাঙায়। প্লানটা দ্বীপ্ত ভাইয়ারমিয়াভাই গাইগুই করছিলো। কিন্তু আমি দ্বীপ্ত ভাইয়া র সাথে তাল দেয়া শুরু করলাম। রহিম কিছু না বুঝেও বললো, ‘অনেক মজা হবেনে’আমরা বনভোজনে এসেছি।

মিয়াভাই বললেন, ‘বনভোজনটা সুন্দরবনে গিয়েই করলে হত। তাহলে বনভোজনের নামকরণের স্বার্থকতা হত। আর দ্বীপ্ত তুই যে এত সুন্দরবন দেখার বায়না ধরতি, আর এখানে এসে তো একবারও বলিস না। ব্যাপার কি?’

‘এতদিন বলতাম। এখন সুন্দরবন দেখানোর দ্বায়িত্ব তোরতোর যা ভাব দেখছি তাতে মনে হয় না সুন্দরবনে নিয়ে যাবিসুন্দরবন না দেখেই মনে হয় ফিরে যেতে হবে। এজন্যই আলসে লোকের সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে নেই।’

‘এখন আমার উপর দোষ চাপাচ্ছিস না! নিয়ে যাবো না মানে । আগামীকালই নিয়ে যাবো’

‘ দেখা যাবে ঘুম কুমারআগামীকাল আগে আসুক।’

মধ্যির ডাঙায় বড় ঝাকড়া চটকা গাছের নিচে মাদুর পেতে বসেছে ফুফু আর তার বাল্য কালের সখী ‘সুখী’ ফুফু। সুখী ফুফু গতকাল ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে আগে ছিলো বাপের বাড়ি এখন হয়েছে ভাইয়ের বাড়ি। আগে সুখী ফুফু বাপের বাড়ি আসত, এখন আসে ভাইয়ের বাড়ি। এখান থেকে ফিরে যাবে স্বামীর বাড়ী। মেয়েলোকের নিজের বাড়ী তাহলে কোনটা! সুখী ফুফু এলে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে আসবে। ছোট বেলার সখীকে এক নজর না দেখে সে যেতে পারে না। দুই বান্ধবী ঘরে বসে ছেলেবেলার মত গল্প জুড়ে দেয়। আজ সকালে ফুফুর সাথে দেখা করতে আসে। আমরা তাকেও বনভোজনে নিয়ে এলামরহিমকে নিয়ে মিয়াভাই মাটিতে চুলা খুঁড়ছেদ্বীপ্ত ভাইয়া আলুগুলোর খোসা ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। আমি মাংসগুলো ধুয়ে আনলাম পুকুর থেকে। ফুফু বললেন, ‘এদিকে নিয়ে আয়। কেমন ধুয়েছিস দেখে নি’।


পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফুফু ‘ধৌতকরন’ ভালো হয়েছে বলে সার্টিফিকেট দিলেন। এও বলতে ভূললেন না এবার থেকে বাড়িতে তরিতরকারী সব ধোয়ার দ্বায়িত্ব থাকবে আমার উপর। দেশী মোরগের মাংস দিয়ে ভুনা খিঁচুড়ি রান্না হবে। বাবুর্চি আমাদের দ্বীপ্ত ভাইয়াসকালে মোরগটা ধরতে গিয়ে ঘন্টাখানেক লেগে গেলো। রহিম মাছ ধরা খ্যাপলা জাল ছুড়েও ধরতে পারে নাই। দ্রুত ছুটে যায়। শেষে মর্জিনা রান্নাঘরের দরজা খোলা রেখে একমুঠো চাউল রেখে এলো। ডান বাম ক্লিয়ার দেখে মোরগটা সাবধানে রান্নাঘরে ঢুকলো। মর্জিনা টুক করে দরজার শিকল তুলে দিলো। ঘরের ভিতর আগে থেকে ওঁত পেতে আছি আমি আর রহিম। ফাঁদে আটকা পড়ে মোরগটার সেকি দাঁপাদাঁপি।

ফুফু তো কিছুতেই আসবে না। ঘর দোর থাকতে বন বাঁদাড়ে গিয়ে কেন রান্না করতে হবে। এইসব পাগলামি কে কবে শুনেছে। মানুষে বলবে কি ! সে সুখী ফুফুকে সাক্ষী মানে। মুখ টিপে হাসে। বলে, ‘চলই না। গিয়ে দেখি পাগল গুলো কি করে’।



তবুও সারা পথ ফুফু বিড়বিড় করতে লাগলো। মাথায় ইয়া লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে নিয়েছে। সুখী ফুফু বললেন, ‘সই, বাপের দেশে এত ঘোমটা দেয়ার কি আছে। মাথায় কাপড় দ্যাও শুধু’।

ফুফু শুনলেন না। শিরাজ মিয়ার বাড়ির কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী বের হয়ে হাসিমুখে সুখী ফুফুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বু, তুমার সাথে কাগে বাড়ির নতুন বউ যাতিছে?’

ফুফুর কথা গ্রামের সবাই জানে। শিরাজ মিয়ার বউও জানে। সুখী ফুফু হেসে জবাব দিলো, ‘হবে কারো বাড়ির। তুমি বউ আবার মুখ দেকতি চায়ে না কলাম। আমাগে বউয়ের শরম বেশী’।

এখানে এসে মর্জিনা আলু কোটা শুরু করে দিলো মর্জিনা হলো কোটনা শিল্পী। সে কারো বাড়ি গেলে বটি পেতে বসে যায় কুটতে। মাছ শাক সবজি কোন কিছু কুটতে তার আলস্য নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা সে একমনে বসে তরকারী কুটতে পারে। এই মেয়ের জন্ম হয়েছে মনে হয় তরকারী কোটার জন্য। দ্বীপ্ত মর্জিনাকে ফুফুদের পিছে গিয়ে বসতে বললো। ‘আজ মেয়েরা কোন কাজ করবে না। আমরাই সব করবো’শুনে সুখী ফুফুও গালে হাত দিলো। ‘পাগল ছেলেরা কয় কি! আমরা থাকতে তোমরা রানতি যাবা ক্যান? আর মর্দ মানুষ কি রানতি পারে নাকি। কোন দিন তো চুলোর পিঠে যাও নাই!’

ফুফু বললেন, ‘গাছ তলায় বসে রান্না করলি ভুতে নজর দেবেপেট খারাপ হয় তাতে

আমরা শুনে হাসি। বিজ্ঞান মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে দিয়েছে আর ফুফু সেই আগের জমানার বিশ্বাসেই রয়ে গেছেনরান্না শুরু হবে। কিন্তু আমরা কিছুতেই চুলা ধরাতে পারছি না। সাদা ধোঁয়া কালো ধোঁয়া গাছের মাথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছেকিন্তু আগুন জ্বলছে নাআমরা চারজনে পারলে ফু দেই একসাথে। আমাদের কান্ড দেখে ফুফুরা বাচ্চা মেয়ের  মত হেসে উঠলো। শেষ পর্যন্ত মর্জিনা চুলা ধরিয়ে দিলো। ফুফুরা গভীর মনোযোগ নিয়ে রান্না বান্না দেখতে লাগলো। তারা তো বিশ্বাস করেনি যে শেষ পর্যন্ত আমরা রান্না করতে পারবো। আসার সময় ফুফু মাকে বলে এসেছে আমাদের জন্য রান্না করে রাখতে।

অবশেষে রান্না শেষ হলো। আমরা সবাই মধ্যির ডাঙার এক এক করে রহিমের গামছা পরে পুকুরে ‘গা ধুয়ে’ নিলামরহিমের জন্য মিয়াভাই এবার যে নতুন জামাটা এনেছে, আজ সে সেই জামাটা পরে এসেছে। নতুন জামাটায় কালি লেগে যাওয়ায় বেচারার মন খারাপ মর্জিনা বলল, বাড়ি গিয়ে ভালো করে সাবান দিয়ে দেবেতাতেও তার মন খারাপ কিছুটা কমলো না।

আমরা খেতে বসলাম। রান্না খুবই ভালো হয়েছে। ভুনা খিঁচুড়ি আমি দুই প্লেট খেয়ে ফেললামআমার তো তার হাতের রান্না খারাপ লাগতেই পারে না। মর্জিনা ফিসফিস করে রহিমকে বলে, ‘কাঁচা মরিচ নেই না। ঝাল কম হইছে’

ফিসফিস করলেও আমরা শুনে ফেললাম। ফুফু বললেন, ‘মর্জিনা তোকে বলেছিনা খাতি বসে খাবারের বদনাম করবি না। গুনা হয়। হাদিসে নবীজী বলেছেন, তোমরা খাবার পছন্দ না হলে খাইয়ো না কিন্তু খাবারের বদনাম করিবা না’ মসজিদের ইমাম সাহেবের মত করে বলার চেষ্টা করলেন ফুফু। শুক্রবারে নামাজের আগে ইমাম সাহেব মাইকে বয়ান করেন।

মর্জিনা ভয় পেয়ে মিনমিন করে বলল, ‘খাবার ভালো হয়েছে। আমি তো খাবারে দোষ কইনি একটা ঝাল চাতিলাম’।

দ্বীপ্ত ভাইয়া সলাজ হেসে বলল, ‘আসলে আমি ঝালের অনুমানটাই ঠিক ধরতে পারিনি। আর সব ঠিক আছে?’

ফুফু বললেন, ‘সব ঠিক আছে বাপতোমার রান্না তো অনেক ভালো হইছেআর শহরের মানুষ ঝাল কম খায় আমরা জানি। তাই তো তুমি আসার পর থাকে রান্নার সময় ঝাল কম করে দি’

মিয়াভাই বাড়িতে আগেই বলেছিলো যেন কম ঝাল দিয়ে রান্না করা হয়। তার বন্ধু বেশী ঝাল খেতে পারে না। ফুফুর কথা শুনে মিয়াভাই হা হা হা করে হেসে ঊঠলেন, ‘দ্বীপ্ত এখন কি ভাবছে জানো। ভাবছে এই যদি কম হয় তবে বেশীর নমুনা কি! প্রথম দিন খাওয়ার পর আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো এক দিনে আমাদের বাড়িতে কয় কেজি মরিচ লাগে!’

দ্বীপ্ত ভাইয়া প্রতিবাদ করে বললেন, ‘কখনোই না। আপনাদের রান্না আমার খুব ভালো লাগছে। বিশেষ করে মুলা বেগুন দিয়ে ভেটকি মাছের কারিটা জোস লাগছে। ফুফু আমাকে রান্নাটা  শিখিয়ে দেবেন?

ফুফু জানতে চাইলেন, ‘কারি কি?

মিয়াভাই বললেন, ‘তরকারিকে ইংরেজীতে কারি বলে’

রহিম বলে উঠলো, ‘তাই। ইংরাজী এত সুজা?’

আমরা গ্রামের অন্যান্য বাড়ির তুলনায় ঝাল কম খাই। কিন্তু এটুকুও দ্বীপ্ত ভাইয়ার জন্য বেশী হয়ে যায়। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করে দেখেছি সে ভাত খাওয়ার মাঝে ঘনঘন পানি খায়। মাছ মাংসের ঝোল ভাত দিয়ে  মুছে নেয়। ঝালের উত্তাপে তার লাল ঠোঁট আরো বেশি লাল হয়ে যায়। শীতের দুপুরে তার শুভ কপোলে মুক্ত দানার মত বিন্দু ঘাম জমে যায়


-----------------------------------------------------------------



1 টি মন্তব্য:

Unknown [প্রতুত্তর]

আমার রহিম কে খুব ভাল লেগেছে।এমন একটা ভাই থাকলে বেশ মজা করা যায়।