সময় যেন আর কাটে না, বড়
একা লাগে ...
দ্বীপ্ত
ভাইয়া চলে যাবার পর খুব একা মনে হয়। চারপাশের সেই চিরচেনা মুখ গুলো আগের মতই আছে।
তবুও নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত মনে হয়। জন মানুষের মাঝে থেকেও আমি বড় নি:সংগ
বোধ করি। শুধু মনে পড়ে সেই মুহুর্তগুলোকে যা আমাকে দিয়েছে কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার দিয়ে যাওয়া শার্টটা পরি।
শার্টটা পরলে মনে হয় দ্বীপ্ত ভাইয়া আমাকে আলিংগন করে আছে। আমি তার স্পর্শ পাই,
তার শরীরের গন্ধ খুঁজে ফিরি এই শার্টে। আমি মিয়াভাইয়ের ঘরের তালা
খুলি। আমার প্রথম মিলনের সাক্ষী এই পালংক খাট। আমি খাটের উপর শুয়ে থাকি। বালিশে
মাথা রাখি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ব্যবহার করা বালিশে চুমু খাই। চোখ ফেটে জল আসে। একা একা
কাঁদি।
বিকেলের
হেটে বেড়াই শালিক খালী নদীর পাড় ধরে। সবুজ
ঘাসে মুখ ডুবিয়ে এক মনে ঘাস খাচ্ছে নতুন দাদীর ছাগল দুটি। ছগীর শেখ খ্যাওলা জাল
ছূড়ে মাছ ধরছে। খারাই হাতে মাছ কুড়াচ্ছে তার বাচ্চা মেয়েটা। দুটি সাদা বক পাশাপাশি
উড়ে গেলো বাঁদার দিকে। বাড়ির উঠোনের সব্জি বাগান থেকে ওলকপি তুলছে আর পান চিবুচ্ছে
নতুন দাদী। বাঁশের সাঁকোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের কথা শুনছে ছাকা মাঝি
ও গফুর গাছি। ইমাম সাহেবের নাম কাইয়ুম
মৌলভি। চার গ্রাম পরে লেবুপাতা গ্রামে তার
বাড়ি। আমি সামনে এগিয়ে যাই। কিছুদুর
পরে সবুরদের বাড়ি। সবুরের দাদি সবুরকে গজা
খাওয়াচ্ছে বারান্দায় বসে। মোড়লপাড়ার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম,
কে যায়?
ঘরের
দাওয়ায় বসে জাল বুনছে মোজাম মিয়া। মোজাম
মিয়া জন্মান্ধ। পৃথিবীর রূপ সে কখনো দেখেনি । তবুও সরস একজন মানুষ। আমাদের বিচিত্র
সব গল্প শোনায় । তার বর্ননা শুনলে চোখের সামনে সিনেমার মত ভেসে ওঠে সব। আরব দেশের গল্প সে
বেশী করে। চোখে যারা দেখে না তাদের কান
অনেক শার্প হয়। আমি হাঁটছিলাম আপনমনে খুব আস্তে
ধীরে। তাও সে শুনতে পেলো। ডাক
দিলো।
আমি
উত্তর দিলাম , "আমি " । দ্বীপ্ত ভাইয়া হলে বলত, আমি দ্বীপ্ত। আমার গলার স্বর শুনে মোজাম কানা আমাকে চিনতে পারলো,
ও ছোড খুকা। আসো। এইহানে বসো। দুডো গল্প করি।
আমার
তেমন কোন তাড়া নেই। বারান্দায় পাতা খেঁজুর পাটির উপর উঠে বসলাম। রসের জন্য খেঁজুর গাছ কাটার আগে বাইল্লে কাটা
হয়। খেঁজুরের পাতা দিয়ে পাটি বোনে চাচী। মোজাম কানা ভালো জাল বুনতে
পারে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে জাল বোনে আর গুনগুনিয়ে গান গায়। মহুয়া সুন্দরীর পালা,
বেহুলা লক্ষীন্দরের পালা, ভানুমতির পালা
সব তার মুখস্ত। গলার সুরও চমৎকার্।
জুম্মাবারে সে লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে চলে যায় মসজিদে। মুয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার আগে
সে সুললিত স্বরে গজল গায় দুই তিন খানা।
গ্রামের বউঝিরা কাজের ফাঁকে তার গজল শোনে।
মোজাম কানার বিয়ে হয় গরীব এক চাষীর মেয়ের সাথে। একে তো গরীব চাষা তার উপর একখান
ছেলের আশায় তার ছয়ছয়খান মেয়ে হলো পরপর । এত গুলো পেটের অন্ন জোগাতে সে চোখে সর্ষে
ফুল দেখে। পারলে তো সে মেয়েগুলোকে গাঙের জলে ভাষায় দেয়। সেই ছয় মেয়ের একজন মোজাম চাচার বউ। শত দু:খ কষ্ট মুখ
বুঝে সহ্য করা আশ্চর্য্য সহনশীল এক রমনী। তাদের একটা ছেলে ছিলো। বেশ সুন্দর দেখতে
। সবাই কোলে নিয়ে আদর করত। সবার কথা শুনে মোজাম কানা খুশীতে পুলকিত হত। ছেলের মুখে
পিঠে, হাতে পায়ে সে হাত বুলিয়ে ছেলের সৌন্দর্য্য দেখার
চেষ্টা করত। গায়ের
রং বাপ মাকে ছাড়িয়ে যায় । তাই নিয়ে ওপাড়ার মেজদাদির মত লোকেরা এই চাচীর নামে
সারা গাঁয়ে কুৎসা রটাতে ছাড়ে না। ঘটনার কোন সত্যতা ছিলো না। তাই একসময় আর কেউ ওসব
কথায় গা করতো না। সাত বছর বয়সে তাদের ফুটফুটে ছেলেটি তিন দিনের কালাজ্বরে মারা
যায়।
‘
চাচী কই ?
‘
ধান ভানতি গেছে শাবুদ্দি মোড়লের বাড়ি।
গরীব মানুষের বেটি, গরীব মানুষের বউ সারা জীবন শুধু খাঁটে গেলো। সুখ
পাইলো না একটু।
‘
চাচা , তোমার কি মন খারাপ ?
‘
নারে বাপ। মন খারাপ না। নিত্যি অভাবের
সংসারে মন খারাপকে পাত্তা দিলি কি জীবনের এতডা পথ পাড়ি দিয়ে আসতি পাত্তাম। বাজান
বাঁইচে থাকতি আমারে নিয়ে খুব চিন্তা করত। বেশী জমিজমা নেই। কি হবে আমার?
এই ভাবনায় তার রাইতে নিদ হইতো না। তার আওলাদকে ভিক্ষে করে খাতি
হবে সারাজীবন। না। ভিক্ষে আমি করিনি। কতদিন শুধু নুন দিয়ে হাত খাইছি, কতক দিন তাও জুটতো না। খিদের জ্বালা বড় জ্বালারে বাপ। হিতাহিত জ্ঞান
থাকে না মানুষের্। তবু কখনো হাত পাতিনি কারো কাছে। যাকাত ফেতরা কেউ বাড়ি এসে দিয়ে
গেলে নেই। এই টুকু না নিয়ে তো পারিনে। দুটো মানুষের পরনের কাপড় তো কেনা লাগে
। জীবন কাটায়ে দিলাম ঘর আর বারান্দায়। এই
জীবন যে কি কঠিন তা যে পার করে সেই শুধু জানে।
মাইনষে
কয় কানা খুড়া বুবা মানুষগো আল্লাহ বেশী ভালোবাসে। আমার তো মনে হয় না আল্লাহ আমাগে
ভালোবাসে। আমারে যদি আল্লাহ ভালোবাইসতো তাহলে কি কানা করে পয়দা করত । জাহান্নামের
জীবন কি দুনিয়ার অপূর্ন জীবন থেকে কঠিন!
বুঝলে শুভ্র মিয়া। জেবন অনেকক কঠিন। জেবনে অনেক বালা মসিবত আসপে। কাছের
মানুষ পর হয়ে যাবে। তখন কিন্তু ঘাবড়ালি চলবে না।
এই
সময় চাচী ফিরে এলো। আঁচলে তার চাউল বাঁধা।
মোজাম কানা ব্যকুল হয়ে বললো , " চাইল
আনিছো। শিজ্ঞির ভাত চড়াই দাও। দুই দিনের খিদে চাগান দিয়ে উঠিছে চালের গন্ধে। " চাচী আমার সাথে দুটো কথা বলে ঘরের
বারান্দায় পাতা চুলায় আগুন ধরাতে বসলো। পাতার আগুনের ধোঁয়ায় সারা বারান্দা অন্ধকার
হয়ে গেলো। আমি উঠে পড়লাম। দোকানের দিকে জোরে পা চালালাম।
দুই
দিন। এই দুটি মানুষ দুই দিন না খেয়ে আছে। কারো কাছে হাত পাতে নি পেটের জন্য।
অভুক্ত শরীরে আধা বেলা ধান ভেঙে সে কেজি পাঁচেক চাল নিয়ে ফিরেছে ঘরে। শিমের মাঁচা থেকে কয়েকটা শিম ছিড়ে ভাতের
হাড়িতে দিয়ে চুলায় বসিয়ে দিয়েছে চাচী। চুলার আগুনের আভা চাচীর মুখে। সে মুখে
কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, কষ্ট নেই। নিজের অজান্তে
দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।
1 টি মন্তব্য:
তোমার লেখাগুলো খুব সুন্দর ।ভীষণই ভালো
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন