মায়ের
ডাকে ঘুম ভাঙলো। “হু” বলে ডাক শুনে আমি পাশ ফিরে শুইলাম। শীতের দিনে শেষ রাতে
বিশেষ করে ভোরের ঘুমটাই বেশী মজার লাগে। মা আমার মুখের উপরের কম্বল সরিয়ে বললেন, ছোট খোকা! কি রে ভূলে গেছিস? ঘাটে যাবি না?
‘
সকাল হয়ে গেছে?
‘
সেই কখন ফজরের আজান দিয়েছে। এতক্ষণে তো ঘাটে লঞ্চ চলে আসার কথা। তুই
যাবি না রহিমকে একা পাঠিয়ে দেবো?
‘
মিয়াভাই আসছে আর আমি যাবো না তাই কি হয়। তুমি শার্টটা দাও।
বাইরে
প্রচন্ড ঠান্ডা। কনকনে শীতে হাঁড়ে কাঁপণ ধরিয়ে দেয়। শার্টের উপর শাল খানা চাপিয়ে
পা বাড়ালাম।
এই শালখানা মিয়াভাই গত তারিখ বাড়ি আসার সময় নিয়ে এসেছিলো। কিছুদূর হাঁটার পর শীত
কেটে গেলো। নিমের দাঁতন দিয়ে মেসওয়ার্ক
করতে করতে হাটছি। আমার পিছে পিছে পা ফেলছে রহিম। রহিম
আমার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। বাড়ির টুকটাক কাজ করে, গরু বাছুর গুলো দেখাশোনা করে। বেশ
হাসিখুশী প্রানচঞ্চল একটা ছেলে। বিকেলে মাঠ থেকে
গরু আনার সময় খোলা মাঠে গলা ছেড়ে গান গায়। কেউ কোন কাজ করে দিতে বললে সানন্দে লেগে
যায় সেই কাজে। সব কাজে সে মজা খুজে পায়। অথচ চারকূলে কেউ নেই তার। আব্বা এক হাঁটবারে তাকে সাথে করে বাড়িতে আনে।
সেই থেকে সে আমাদের বাড়িতে আছে। আব্বা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো। কিন্তু
ক্লাস ফাইভ সে পেরোতেই পারলো না।
‘
কিরে রহিম, স্যান্ডেল কই তোর? এই শীতে খালি পায়ে আইছিস ক্যান?
‘
ছোড ভাই, স্যান্ডেল পরলি পা কুটকুট করে। আর জুতো
পায়ে আমি জোরে হাঁট্টি পারিনে। খালি পায় হাট্টি আমার খুব ভালো লাগে। ম্যা’ভাই ইবার
কদিনের ছুডিতে আইলো?
‘
বেশি কথা না কয়ে পা ফেল। লঞ্চ মনে হয় ঘাটে চলে আইছে এতক্ষণে। আরো আগে বারুতে হতো।
‘ না ভাই। এহনো আসে নাই। আসলি লঞ্চের গুড়গুড় শুনা
যাতো।
আমাদের
বাড়ী সুন্দরবনের খুব কাছে। গ্রাম থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব আড়াই মাইলের মত হবে।
লঞ্চঘাট বানিয়াখালিতে। বানিয়াখালি ঘাটের ওইপার থেকে সুন্দরবন শুরু। এখানে যোগাযোগ
ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। বড় ভাইয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছে। অত্র এলাকায়
ভাইয়াই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র। গ্রামে বিএ পাশ কয়েকজন আছে। কিন্তু তারা
সবাই খুলনার বিএল কলেজে থেকে পাশ করা। ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে
করে খুলনা আসা যায়। এরপর আইডব্লিউর ঘাট থেকে লঞ্চে করে আমাদের গ্রামে আসতে হয়। রাত
দশটার লঞ্চে উঠলে আমাদের এখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যায়। পুরো এক রাতের
মামলা। আর এখন শীতের সময়। কুঁয়াশার কারণে লঞ্চ খুব আস্তে চলে। মোড়ল পাঁড়া পার
হওয়ার সময় অজেদ মোড়লের পুকুরে নেমে নিমের দাঁতন ফেলে দিয়ে কুলি করে মুখ ধুয়ে
নিলাম। এই পুকুরের চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু গাছ। পুকুরের রোদ খুব একটা পড়ে না। তাই
পানি বরফ ঠান্ডা হয়ে থাকে। গরমকালে এই পুকুরে গোছল করে শান্তি লাগে। গামছা কাঁধে ফেলে আমরা
গোছল করতে চলে আসি। মুখ ধুয়ে লুঙ্গির খুঁটে মোছার আগেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া আমার
নাকের ডগা ছুয়ে উড়ে গেলো। সেই ঠান্ডায় সমস্ত শরীর হিড়হিড় করে কেঁপে উঠল।
লঞ্চ
ঘাঁটে গিয়ে দেখি শুনশান নিরবতা। কেউ কোথাও নেই। নদীর উপরে সাদা কুয়াশার মশারি টাঙানো।
এখনো লঞ্চ আসে নাই। শব্দও পাওয়া যায় না। নদীর ওইপারে সুন্দরবন। ঘন সবুজের সমাহার।
কিন্তু কুয়াশার চাঁদরে মোড়া বলে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। মিনিট
পঞ্চাশেক বসার পরে লঞ্চের শব্দ শুনতে পেলাম। অপেক্ষার পর এই গুড়গুড় শব্দ কানে মধুর হয়ে উঠলো। আমি ঘাটের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। শব্দ
শোনার আরো মিনিট দশেক পর লঞ্চের দর্শন পাওয়া গেলো। মালপত্তর
সহ ভাইয়াকে নামিয়ে নিলাম। রহিম ব্যাগপত্র কাঁধে
তুলে নিলো। ভাইয়ার সাথে তার এক দোস্ত এসেছে। সিনেমার নায়কদের মত দেখতে। কুয়াশাঁর কারনে সব পিছল হয়ে আছে। ভাইয়া তাকে
হাত ধরে নামালো। আমি কাছে গিয়ে সালাম দিলাম। মিয়াভাই বললেন, “দ্বীপ্ত, এ হচ্ছে
শুভ্র। আমার ছোট ভাই।” নায়ক মার্কা ভাইটা পকেট থেকে হাত বের করে আমার সাথে
হ্যান্ডশেক করলো। বেশ ফর্সা সুন্দর হাত। হাতের আঙুল গুলো পুরুষ্ট।
মানুষ
এত ফর্সা হয়? আমি আগে কখনো দেখিনি।
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন