‘সুখে আছে যারা ,
সুখে থাক তারা...’
রাতটা
সুখেই কেটে গেলো। ভোরের আলো কখন যে জানালার ফাঁক গলে ঘরে উঁকি দেয়া শুরু করেছে
বলতে পারবো না। ঘুম ভাঙলো দ্বীপ্ত ভাইয়ার মৃদু ঝাঁকুনিতে। আস্তে আস্তে করে ডাকছে,
এই শুভ্র। আমি চোখ মেললাম। গত রাতের ক্লান্তি এখনো শরীরে। চারটার
কিছু আগে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি দ্বীপ্ত ভাইয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলাম। চুমুটা
বেশিক্ষণ দীর্ঘায়িত হলো না। দরজায় রহিমের ডাকাডাকি শুনে দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার ঘুম
ভাঙায়। তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম। বিপদের উপর বড় বিপদ। লুঙ্গিত গেলো কোথায়? রেখেছিলাম
কোথায় সেটাই মনে করতে পারছি না। এখানেই থাকার কথা। ছাদে তো রাখতে যাই নাই। খুঁজে পাচ্ছি
না। আজ মান ইজ্জত না পাংচার হয়ে যায়। দুজন মিলে কম্বলের ভিড়ে খুঁজতে। আরে
এটা তো দ্বীপ্ত ভাইয়ার প্যান্ট। দ্বীপ্ত ভাইয়া ঝটপট
প্যান্টে পা গলিয়ে নিলো। কিন্তু আমার লুঙ্গি কোথায়! অবশেষে লুঙ্গি খুঁজে পাওয়া
গেলো পালংকের নিচে।
মশারী গলে খাঁটের নিচে লুঙ্গি কিভাবে গেলো সেটা জগতের একটা বিস্ময়। লুঙ্গি পরতে
পরতে টপাক করে আরেকটা চুমু খেলাম দ্বীপ্ত
ভাইয়ার ঠোঁটে।
বাইরে
এসে দেখি ভাইয়া আর আব্বা দুজনেই ফিরে এসেছেন। মামলায় রায়ে আমাদের জিত হয়েছে। যাক
বাঁচা গেলো। জমি জিরাতের মামলার মত ফ্যাঁসাদ আর নেই। হাত মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে
বসলাম। খুলনা টাউন থেকে আনা সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারি থেকে আনা মিষ্টি পিরিচে করে রেখে
গেলো মর্জিনা।
নাস্তা শেষে মিয়াভাই ঘুমাতে গেলেন। বরাবরই আমি খেতে পছন্দ করি। নিন্দুকেরা আমাকে পেটুক বলে
বদনাম করে। মা বলে আমি খেতে খুব ভালোবাসি এবং আমাকে খাইয়ে তিনি তৃপ্তি পান।
মিষ্টি
অর্ধেক খাওয়া শেষ। মিয়াভাই ও ঘরে ঘুমুচ্ছে। দ্বীপ্ত ভাইয়া সন্তর্পনে দরজাটা চেপে
বারান্দায় এসে বসলেন। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি
ব্যাপার? শহুরে সাহেব এত ভোরে বিছানার বাইরে কেন?’
‘ঘুম
ভেঙে গেলো’।
‘তাহলে
মুখ ধুয়ে ফেলে মিষ্টি খাও। মর্জিনা পুকুর থেকে ছোট বালতির এক বালতি পানি দিয়ে যা
তো’।
মর্জিনা
রান্না ঘর থেকে বলল, ‘দুই মিনিট পরে দিতিছি ছোড ভাই। চুলো থাকে ভাজিডা নামায়ে থুয়ে
আসতিছি’।
দ্বীপ্ত
ভাইয়া হাই তুলে বলল, ‘এখন মিষ্টি খাবো না। ঘুম থেকে উঠে কেউ মিষ্টি খায়!’
‘ঘুম
থেকে উঠে মিষ্টি খেলে কি হয়?’
‘কিছুই
হয় না। তুই খা’।
মর্জিনা
পানি দিয়ে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া হাত মুখ ধুয়ে নিলেন। ফুফু ঘর থেকে এক খানা গামছা
হাতে বেরিয়ে এলেন। দীপ্ত ভাইয়া গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বললেন,
‘চল শুভ্র, ভোরের হাওয়ায় কিছুক্ষণ খালি পায়ে
ঘুরে আসি’।
আমি
বললাম, ‘চলো’।
ফুফু
ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘এই কো এর মদ্যি বাইরে যাওয়ার কি দরকার! তাও খালি পায়ে!’
দ্বীপ্ত
ভাইয়া বললেন, ‘ফুফু গ্রামের মানুষ গ্রামে থাকে বলে খালি পায়ে হাঁটার মজা বুঝতে
পারে না। শহরে আমাদের সারাক্ষন জুতা পরে থাকতে হয়। কত বছর যে মাটিতে পা দেই না তা
নিজেও মনে করতে পারছি না’।
‘ক্যান,
তোমাদের বাড়ি উঠোন নেই’।
‘উঠান।
নাহ’।
ফুফুর
গলায় সন্দেহ, ‘উঠোন ছাড়া কি আবার বাড়ি হয় নাকি! ঘরের পরেই কি রাস্তা’।
‘না।
ঘরের পরেই রাস্তা না। অল্প একটু জায়গা আছে। কিন্তু সেটুকুও ইট সিমেন্টের তলায় ঢাকা
পড়ে গেছে’।
‘যাও
তাহলে। কিন্তু খালি পায়ে বেশীদূর যাবা না। কাল ধরে যাবে’।
দ্বীপ্ত
ভাই কাল ধরে যাওয়া না বুঝতে পেরে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ‘ঠান্ডা লেগে
যাবে’।
দ্বীপ্ত
ভাইয়া হেসে ফেললেন, ‘কিচ্ছু হবে না ফুফুজান। আমি তো আর বাচ্চা ছেলে না যে এইটুকুতে
ঠান্ডা বসে যাবে’।
‘তবুও
বাপ, কথায় আছে না, সাবধানের মাইর নেই’।
ফুফু
মর্জিনাকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে চললেন। আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। কুয়াশাঁ
কাটেনি এখনো। চোখের সামনে দুধ সাদা কুয়াশাঁর চাদর। সেরকম ঠান্ডা নেই। আমরা দুজন
হাত ধরে হাঁটছি। আজ দ্বীপ্ত ভাইয়ার দেখাদেখি আমিও সোয়েটার পরেছি। গত বছর এই
সোয়েটারটা কিনেছিলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ের গায়ে সাদা কালো ডোরাকাটা সোয়েটার। পিছন দিকে
হট হট শব্দ শুনে আমরা রাস্তার সাইডে সরে দাঁড়ালাম। মুখে হট হট শব্দ করে রহিম গরু
গুলোকে তাড়িয়ে মাঠে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আস্তে ধীরে হাঁটছি। রহিম আমাদের ছাড়িয়ে
গেলো। কালো দামড়াটা অনেক বেয়াড়া। এর গাছ খায়, ওর
বেড়া ভাঙে। ওকে কন্ট্রোল করতে রহিমকে লাঠি হাতে ছুটতে হচ্ছে। সামনের ইদে কুরবানি দেয়ার জন্য গরুটাকে রাখা হয়েছে।
পায়ের
নিচে শিশির ভেজা ঘাস। দ্বীপ্ত ভাইয়া বহুকাল পরে ঘাসে পা দিয়েছেন। পায়ের
নিচে ঘাসের সুড়সুড়ি লাগার অভিব্যক্তি তার চোখে
মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কথা বলতে বলতে আমরা মদ্যির ডাঙা পর্যন্ত চলে এসেছি। মদ্যির
ডাঙায় কেউ থাকে না। অন্য গাছের সাথে উচু উচু অনেকগুলো খেঁজুর গাছ আছে। গফুর
গাছি গাছ থেকে ভাড়ে করে রস নামাচ্ছে। একজায়গায় অনেকগুলো
মাটির ভাড় জড়ো করে রাখা। বিভিন্ন গাছ থেকে রস পেড়ে এনে এখানে একত্র করা হচ্ছে। কয়েকটি
ভাড় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে আছে। ভাড়ের মুখে রসের ফেনা লেগে আছে। আমাদের এদিকে রসের
ফেনাকে বলে ‘গ্যাঁজা’। গ্রামীন উচ্চারণ ‘গিঁজা’। আমাদের দেখে মাঝ গাছ থেকে গফুর গাছি ডাক দিলো, ‘কিডা
যায়?’
‘এইতো
আমরা। আইজকে রস কখান হলো গফুর কা?’
গাছ
থেকে গাছি ততক্ষনে নেমে এসেছে। মাটিতে রাখা আধাভরা একটা ভাড়ে হাতের ভাড় থেকে রস
ঢালতে ঢালতে বললো, ‘রস হলো এই ধরো সাতখান। আরো
দুখোনের মত হবে। সাথে এ কিডা?’
‘
ভাইয়ার বন্ধু’।
‘
খুইল্লে শহরে বাড়ি?’
‘
না ঢাকায়’।
‘
ও ঢাহায়। রস খাও। দাড়াও দিতিছি’।
‘
না থাক। এখন রস খাবো না’।
‘
আরে থাকপে ক্যান। সাথে শহরের কুটুম। আমাগে শাহ জালাল ভাইয়ের বন্ধু মানুষ’।
দ্বীপ্ত
ভাইয়া হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালো। গাছি গলায় ঝোলানো গামছায় ভালো করে হাত মুছে
হাত মেলালো। গাছিকে কখনো চাদর কি জাম্পার পরতে দেখা যায় না। গরমের সময় খালি গায়ে
কাধের উপর গামছা থাকে। পাতলা হাফ হাতা ফতুয়ার উপর গামছা খানাই তার শীতের সাজ। একটা
ভাড়ের গলায় এলুমিনিয়ামের গ্লাস বাঁধা। গ্লাসটা ভালো করে ধুয়ে এনে তাতে রস ভরে
বাড়িয়ে দিলো। গাছি বললো, ‘তোমরা রস খাতি
থাকো। আমি ভাড় খান পাইতে দিয়ে আসতিছি। উলা
রসের গুড় বানাতিছি এবার’।
গাছি
তরতর করে দক্ষিণ দিকের একটা “খাঁজুর” গাছে উঠে গেলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার দিকে ফিরে
জিজ্ঞেস করলো, ‘উলা রস কি?’
‘খেঁজুর
গাছ প্রথম কাটা হয় সন্ধ্যায়। আমাদের এদিকে বলে গাছ তোলা। গাছি গাছ তুলে ভাঁড় পেতে
দিয়ে যায়। মাটির ভাড়কে আমাদের দিকে পুরুল বলে। দাকোপ থানার দিকে আবার ঠিলে বলে।
গাছ তোলার পরে প্রথম যে রস হয় এটাকে রস বলে। আর দ্বিতীয় দিনে যে রস হয় তাকে উলা রস
বলে। উলা রস একটু টক হয় তাই এটা দিয়ে পিঠা না বানিয়ে গুড় বানিয়ে ফেলা হয়’।
‘বুঝলাম’।
ঠান্ডা
শীতল রস বেশ কিছুটা সময় নিয়ে খেলো দ্বীপ্ত ভাইয়া। যখন গ্লাস থেকে মুখ তুললো দেখলাম
তার উপরের ঠোঁটে রসের সাদা ফেনা লেগে আছে। আমি আরেকটু হলে মুছেই দিতাম। কিন্তু
গফুর গাছি চলে আসায় হাত সরিয়ে পেছনের দিকে একটা জমি দেখিয়ে বললাম, ‘ঐ যে জমিটা দেখছো ঐটা আমার জমি’। দ্বীপ্ত
ভাইয়া হাতের তালুতে মুখ মুছে সেদিকে তাকালো। কুয়াশার উপরে সুর্য মামা হাসি মুখে
ভেসে উঠলো।
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন