লঞ্চ
ছেড়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ পল্টনে বসে থাকলাম। রহিম তাগাদা দেয়। ‘ছোড ভাই,
ওঠো। বাড়িত যাবা না। সইন্ধ্যে হয়ে আইলো। শীত কত্তিছে।’
রহিম
চাদর আনে নাই। শীত লাগাটাই স্বাভাবিক। যে পথে গুড়গুড় করে লঞ্চ চলে গেছে সেদিকে
আরেকবার ফিরে তাকালাম। চোখের আয়নায় দ্বীপ্ত ভাইয়ের হাস্যোজ্বল মুখ ভেসে উঠলো।
লঞ্চের নাম মেসার্স মোহাম্মাদি। লঞ্চের ছাদে একটা প্লেনের রেপ্লিকা আছে। তাই এলাকায়
এটা প্লেন লঞ্চ নামে পরিচিত। কয়রা নদী ধরে লঞ্চ এগিয়ে যাবে, হড্ডার মোহনা হয়ে শিবসা নদীতে পড়বে। শিবসা নদী দক্ষিনে
প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। তাই শিবসা নদীর প্রশস্ততা অনেক বেশী।
বর্ষায় শিবসা হয়ে ওঠে প্রমত্তা, মাছ ধরা জেলে নৌকা
গিলে খায়। গরু বাছুর মানুষ পর্যন্ত গিলে খায়। তবু তার ক্ষুধা মেটে না। শীতে শিবসা
অনেক শান্ত। শিবসা পেরিয়ে নলিয়ান ঘাট তারপর আবার কোনাকুনি পাড়ি দিয়ে শান্তা লঞ্চ
ঘাট। এরপর তৃতীয় বারের মত শিবসা পাড়ি দিয়ে জয়নগর ঘাট হয়ে লঞ্চ ঢোকে চুনকুড়ি নদীতে।
কালিনগর, দাকোপ, চালনা ঘাট
পেরিয়ে লঞ্চ এসে পড়ে পশুর নদীর মোহনায়। চালনা ঘাটের পর আর কোন ঘাট নেই। পশুর নদী বেয়ে
লঞ্চ ঢোকে বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদীতে। এরপর রুপসা নদীর নতুন বাজার ঘাট পেরিয়ে আইডব্লিউর লঞ্চ ঘাটে গিয়ে নামবে দ্বীপ্ত ভাইয়েরা।
খুলনা
শহরের সোনাডাঙা বাস স্ট্যান্ড থেকে ঢাকার বাস ছাড়ে। বাস ছুটবে নতুন রাস্তার মোড়, দৌলতপুর, ফুলবাড়ি গেট, শিরোমনি, ফুলতলা পেরিয়ে যশোর। তারপর
নড়াইলের আড়পাড়া দিয়ে মাগুরা, ফরিদপুর অতিক্রম করে পৌঁছে যাবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। এই
ফেরিঘাটকে খুলনা সাতক্ষীরার মানুষ আরিচা ফেরিঘাট নামে চেনে। যদিও মুল আরিচা
ঘাট আরো দূরে। ফেরিঘাটে অনেক জ্যাম থাকে। ফেরি
ঘাট পেরিয়ে মানিকগঞ্জ সাভার হয়ে ঢাকার গাবতলি বাস স্ট্যান্ড। দ্বীপ্ত ভাইয়েরা
গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তখন কি দ্বীপ্ত ভাইয়া আমার কথা সত্যি মনে রাখবে!
‘
ছোড ভাই জোরে হাঁটো। জাড় কত্তিছে’।
‘চাদর
না নিয়ে আসছিস ক্যান বলদা!’
‘খেয়াল
ছেলো না’।
বাতাসটা
আজ অনেক ঠান্ডা। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। জোরে হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু
পা চলতে চাইছে না যেন। পায়ের পাতা দুই মন ভারি বলে মনে হচ্ছে। রহিম কিছু দূর হেঁটে
গিয়ে আমার জন্য থামছে বারবার্।
বাসায়
পৌঁছানোর কিছু পরে এশার আযান শোনা গেলো। আজ অপরিচিত কেউ আযান
দিচ্ছে। ইমাম সাহেব মনে হয় ছুটিতে গেছে। অন্যদিন হলে কে আযান দিচ্ছে এটা বের করার
জন্য রহিমের সাথে আলোচনা শুরু করে দিতাম। স্বাভাবিক ভাবে রহিম জিজ্ঞেস করলো, ‘ছোড ভাই কওতো কে আইজ আয়জান
দিতিছে?’
প্রশ্ন
করে রহিম আমার বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন। বিছানার উপর গলা পর্যন্ত লেপে
ঢেকে আমি শুয়ে আছি। উত্তর না পেয়ে রহিম আপন ভাবনায় ডুব দিলো।
মা
খেতে ডাকলো। বারান্দার কোনায় পোষা শালিক মন্টু থাকলে সেও মায়ের সাথে ডাক দিয়ে বলতো,
‘ভাত খেয়ে যা’। মন্টুর খাঁচা এখনো আছে। সেখানে এখন অপরিসীম
শূন্যতা। সেই শূন্যতা এখন আমি অনুভব করি বুকের গভীরে। আমি লেপের ভেতর থেকে বললাম,
‘আজ রাতে আমি খাবো না মা’। খাওয়ার
রুচি নেই। রহিম খেতে গেলো। রহিম জগতের সুখী মানুষদের একজন। খাওয়া ঘুম আর গরুগুলোকে
দেখাশোনার চিন্তা ছাড়া তার মাথায় আর অন্য কিছু নেই। দুটো খেতে পেলেই সে নাক ডেকে
ঘুমাতে পারে।
মা
রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাবি না কেন? খাবার তোর ঘরে পাঠিয়ে দেবো?’
‘নাহ।
একদম খিদে পায়নি’।
আম্মা
বললেন, ‘শীতের রাত বড় রাত। সারা রাত না খেয়ে
থাকবি? শেষে দেখবি মাঝ রাত্রিরে খিদে লাগিছে’।
আব্বার
কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘একরাত না খেলে কিচ্ছু হবে
না। কয়দিন তো খুব হুড়পাড় করে কাটালো। সবাই চলে যাওয়ায় খারাপ লাগতিছে মনে হয়’।
খাওয়া
শেষে মা ঘরে এসে আমার টেবিলের উপর বাটিতে করে বাড়িতে কোটা নতুন ধানের চিড়া আর
খেঁজুরের পাটালি গুড় রেখে গেলো। গাঁয়ে হাত দিয়ে দেখলো শরীর ভালো আছে কিনা! নতুন
ধান ওঠার পরে আমাদের বাড়িতে গ্রামের আর সব গৃহস্ত বাড়ির মত চিড়া কোটা হয়। নতুন
ধানের চিড়ার গন্ধে বাড়ির বাতাসটা ম ম করে। একেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ
ধুয়ে লুঙ্গির কোচড়ে করে অনেক গুলো চিড়া খেয়ে ফেলি। একমুঠ চিড়ার সাথে এক কামড় করে
খেঁজুরের পাটালি গুড়। কিন্তু আজ চিড়া গুড় অচ্ছুৎ অবস্থায় টেবিলের উপর পড়ে রইলো।
মাঝ রাতে দূর আকাশের তারারা একে একে ঘুমিয়ে পড়তে শুরু করলো। একটা একটা করে সবাই
ডুব দিতে লাগলো অন্ধকারের চাঁদরে। একসময় সাদা সাদা ফুটকি আঁকা আকাশ নামের নকশি কাঁথা
পুরোটাই কালো হয়ে গেলো। এই সময় বাতাসটাও আরো বেশী ঠান্ডা হয়ে যায়। ঘরের সামনের
সিঁড়ির পাশে লাগানো হাস্নাহেনার গন্ধ ভেসে আসে ঘরে। ফুফু বলে হাস্না হেনার গন্ধে
সাপ আসে ঘরে। তিনি আব্বাকে বলেন গাছ গুলো কেটে
ফেলতে। আব্বা হাসেন। আমি ফুফুকে কার্বলিক এসিডের বোতল দেখিয়ে বলি এটা
থাকলে বাড়িতে সাপ আসে না। ফুফু বিশ্বাস করে না। ‘এটা
কি বড় হুজুরের পানি পড়া নাকি যে এর জন্য
সাপ আসবে না!’ রাতে ঘুমিয়ে গেছি কখন তা
নিজেও টের পাইনি। হাঁস মুরগির খোঁয়াড় থেকে লাল মোরগের কক্কর কো শোনা গেলো। আব্বার
গলা খাঁকারির শব্দ শুনতে পেলাম। তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য সিঁড়িতে বসে ওযু
করছেন। তার মানে এখনো সুবহে সাদেক হয় নাই। সকাল হতে আরো অনেক বাকি। আমি পাশ ফিরে শুইলাম। রহিম অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
গায়ের লেপ সরে গেছে সে খেয়াল তার নেই। আজ রাতে খুব একটা কুয়াশা ছিলো না। দ্বীপ্ত ভাইয়েরা এতক্ষণে খুলনা টাউনে
পৌঁছে যাওয়ার কথা। এত সকালে কি তারা কোন
রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করছে নাকি ঢাকার বাসে উঠে পড়েছে!
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন