ছলাৎ
ছলাৎ করে পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দ হচ্ছে। নৌকা তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাগরিবের আজান
হয়ে গেছে বেশ আগে। প্রকৃতি এখন কালো চাদরে মোড়া। কিছুক্ষণ আগেই পশ্চিম আকাশের
কোনায় চাঁদ মামা উঁকি দিলো। দ্বীপ্ত ভাইয়া নৌকার পাটাতনে বসে আছেন। গলুইতে বসে আমি
বৈঠা বাইছি। প্লানটা দ্বীপ্ত ভাইয়ার। আমি তার রুমে গিয়ে বসার
আধা ঘন্টা পরে তার ঘুম ভাঙে। আমার কিন্তু আধা ঘন্টা মনে হয় নাই। মনে হচ্ছিলো
পাঁচমিনিট। ঘুম থেকে উঠে বললেন,
“চল নৌকায় করে ঘুরে আসি”। এ
তো আর শহর না যে ঘাটে গেলেই ভাড়ার নৌকা পাওয়া যাবে। মা অবশ্য হালকা বাঁধা দিলেন।
ঠান্ডা বিকেলে নৌকা চড়ার কি দরকার! দ্বীপ্ত ভাই
আর আমি বেড়াতে যাবো। মনটা আমার আনন্দে তা তা থই থই করে নেচে উঠলো। আজ আমি কোন
বাঁধা মানার পাত্র নই। আমাদের নিজেদের নৌকা নেই। নৌকার প্রয়োজন হলে গ্রামের এর ওর
নৌকা নিয়েই হয়ে যায়। আজ মনে হচ্ছে আমাদের অবশ্যই একখানা নৌকা থাকা উচিত। ব্যাড়ের
খই গাছ কেটে নৌকা বানানোর পরিকল্পণা করে ফেললাম মনে মনে। নৌকা জোগাড় করতে সন্ধ্যা
হয়ে গেলো। রহিম আসতে পারলো না। সন্ধ্যার আগেই তাকে মাঠ থেকে গরু বাছুরী এনে গোয়ালে
তুলতে হবে। চটের মশারি টাঙিয়ে দিতে হবে। ধুয়া দিয়ে মশা তাড়াতে হবে। না হলে সারা
রাত অবলা পশু গুলো মশার কামড়ে কষ্ট পাবে।
আমিও চাচ্ছিলাম না রহিম আমাদের সাথে আসুক। সে একবার বললো আজ না হয় মর্জিনা
গরু গুলোকে গইলে তুলুক। আমি বাধা দিলাম। সন্ধ্যা বেলায় হাস মুরগীগুলো মর্জিনাকে তুলতে
হয় তাকে। এত কাজ সে একা কখন করবে। শেষে মা আমাদের দুজনকেই বকবে।
আমাদের বাড়ী থেকে শালিক খালি নদী মিনিট পনেরো হাঁটা
পথ। পাশাপাশি দুজন হাঁটছি। আমার খুব ইচ্ছে করছে দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত ধরে হাঁটতে ।
কিন্তু কিভাবে ধরি! নিজে থেকে ধরতে সংকোচ লাগছে। বড়ই বেমানান দেখায়। হঠাৎ দ্বীপ্ত
ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। আমি পুলকিত হলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম
না। কি একটা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন। আমার কানেই ঢুকছিলো না। আমি
মন্ত্রমুগ্ধের মত হেটে চলেছি।
এশার
আযানের পর চাঁদ অনেক উপরে উঠে গেছে। এক মোহনীয় মায়াময় আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।
শালিক খালির পানিতে, আমাদের নৌকার উপর, বৈঠায়, দ্বীপ্ত ভাইয়ার মুখে। ডাঙায় ঝোঁপে ঝাড়ে
জোনাকি পোকার মিটিমিটি জ্বলে আর নেভে। লাজ শরম সব যেন ভূলে গেলাম। আমি অপলকে চেয়ে
আছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার চোখে। সেও তাকিয়ে আছে। চোখে যেন আজ নেশা ,
মনে আজ ঘোর। চুম্বকের দুই বিপরীত মেরুর
মত একে অন্যকে টানছি আমরা পরস্পরকে। আমি বৈঠা রেখে
কখন যে পাটাতনে এসেছি জানিনা। কখন যে আমার মাথার পেছেনে দ্বীপ্ত ভাইয়ার হাত এসেছে
তাও জানিনা। মন্ত্রমুগ্ধের মত আমি কখন যে ঠোঁট রেখেছি দ্বীপ্ত ভাইয়ার ঠোঁটে তাও জানি
না। আমাদের দুটি ঠোঁট এক হয়ে গেছে। দুজনের লালা মিশে যাচ্ছে। নি:শ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। শরীর
কাঁপছে। হৃদপিন্ডের ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে। উত্তেজনার মুহূর্তে হার্ট বিট বাড়িয়ে
দেয়। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা।
একটা
সময় কামনার আগুন শীতল হয়ে এলো। আমরা দুজন দুজকে ছেড়ে দিলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া পাটাতনে
শুয়ে পড়লেন। আমি তার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। তিনি বাঁধা দিলেন না। আমাকে টেনে পাশে শোয়ালেন। আমি তার বাহুতেমাথা রেখে
শুয়ে পড়লাম। ঢেউয়ে ভেসে নৌকা একাই এগিয়ে যেতে লাগলো। আমি দূর আকাশে চাঁদের দিকে
তাকিয়ে রইলাম। চাঁদটাকে আজ অসহ্য সুন্দর লাগছে। জ্যোছনার আলোয় সে আজ ভাসিয়ে দেবে
তামাম দুনিয়া। দ্বীপ্ত ভাইয়া গলা ছেড়ে গান ধরলেন। গানটা আমি আগেও শুনেছি। রেডিওতে।
রবীন্দ্র সংগীত। তার গানের গলাও চমৎকার। অনেকটা শ্রীকান্ত
আচার্যের মত। তার সব কিছুই কি চমৎকার!
তোমার
খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি
সকাল
আমার গেল মিছে বিকেল যে যায় তারি পিছে গো
রেখো
না আর বেঁধো না আর কুলের কাছাকাছি...
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন