দরজার
কাছে এসে আমি রান্নাঘরে মুখ বাড়ালাম। ফুফু এবং মা রান্নায় ব্যস্ত। কাজের মেয়েটা
পাটায় মসলা পিষে চলেছে একমনে। মা চুলার উপর কড়াই থেকে চামচে একটু ঝোল নিয়ে ফুঁ
দিয়ে চেখে দেখতে দেখতে ফুফু কে বলছেন, “বু
তুমি এই দুপুর বেলা পায়েস রানতে বইছো। ওরা পায়েস খাবে কখন আর ভাত ই বা খাবে কখন
! বেলা তো গড়িয়ে গেছে”।
‘
ভাত খাবার পরে খাবে। বড় খোকা খাজুরের রসের খির খাতি কত্ত পছন্দ করে। ঢাহার শহরে
কি আর খাঁজুরের টাটকা রস পাওয়া যায়। ব্যান বেলা আমি পায়েস রাইন্দে রাখতি
চাইলাম। তা গফুর গাছি আইজকে রস পাড়তি আসতি দেরিং করবে তা কিডা জানতো।
আমার
দিকে ফিরে বললেন, “দুপুর বেলা এত পড়াশোনা
কের জন্যি। অত পড়লি মাথা খারাপ হুয়ে যাবেনে। যায়ে দেখদিন টিকটিকিটার ঘুম
ভাঙ্গিছে নেই। আর কত ঘুমুবে। সারা রাইত তো লঞ্চে ঘুমুতে ঘুমুতে আইছে। সাথে কুটুম
নিয়ে আইছে। পইর ঘাটে নিয়ে গিয়ে ঘা ধুয়ায়ে আন”।
আম্মা
বললেন, “আমার ঘরে টেবিলের উপর নতুন সাবান আর
গামছা আছে। নিয়ে যা”।
আমি
ভাইয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছি এই সময় ফুফু ডেকে বসিয়ে এক প্লেট রসের
পায়েস খেতে দিলেন। আমাদের ফুফু, আব্বার থেকে
কয়েক বছরের ছোট। অধিকাংশ সময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন দিনের
পর দিন। শত ডাকাডাকিতে দরজা খোলেন না। কারো সাথে কথা বলেন না। খাওয়া দাওয়া করেন
না। এগুলো আমাদের কাছে এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। গ্রামের লোক বলে ফুফুর মাথায় ছিট
আছে। আবার একেক দিন ফুফুর মন খুব ভালো থাকে। আমাদের সাথে দুনিয়ার গল্প জুড়ে
বসেন। ফুফুর দুনিয়া অবশ্য অতি ছোট। পশ্চিমে বাইনবাড়ির মাঠ, উত্তরে হিন্দু পাড়া ,
দক্ষিনে বড় গাঙের পাড় দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা ওয়াপদা রোড আর
পূর্বে শালিক খালির খাল। শালিক খালি এখন শীর্ণকায় এক খাল। দাদীজানের কাছে শুনেছি
এই খাল এক সময় নদী ছিলো। মূল গাঙের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলো। সেখানে এখন বাঁধ দিয়ে
গেট বসানো হয়েছে। একেক সময় খালে কামট কুমির চলে আসত। শালিক খালীর পাড়ে ঘাস খেতে
যাওয়া গরু বাছুর টেনে নিয়ে যেত। একবার দাদীর রাঙা গাইয়ের বাছুরটা কুমিরে টেনে
নিয়ে যায়।
ফুফুর
বিয়ে হয়েছিলো আমার জন্মেরও আগে। ফুফু তখন এক দুরন্ত কিশোরী। দস্যি মেয়ে বলে
সারা গ্রামে অখ্যাতি তার। তরতর করে গাছে উঠে
ছেলেদেরকে হার মানিয়ে দিতে পারে সে। এই নিয়ে দাদি তাকে সারাক্ষণ বকাঝকা করতেন। এমন কোন
সন্ধ্যা পার হত না যেদিন সে দাদির হাতে চুলটানা কি লাঠির বাড়ি খেত না। ফুফু রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতেন। আবার সকালে উঠে
সব ভুলে যেতেন।
ফুফুর
বিয়ে হয় তিনগ্রাম দুরে মাওলানা বাড়ি। ফুফাও মাওলানা ছিলেন। কিন্তু কোন কারণে
তাদের দুজনার মধ্যে বনিবনা হত না। ফুফু কিছুতেই শ্বশুর বাড়ি যেতে চাইতো না। অনেক
জোরাজুরি করে মারধর করেও পাঠানো যেত না। তাবিজ কবজ পানিপড়া কিছুই বাদ গেলো না।
কাজের কাজ কিছু হলো না। শ্বশুর বাড়িতে তাকে অনাদর করা হত বলে শুনিনি। একবার জোর
করে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হলো। সেই রাতেই ফুফু ফসলে দেয়ার " এন্ডিন
" খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। খবর পেয়ে আব্বারা কয় ভাই ছুটে যায় ফুফুর
বাড়ি। হাসপাতাল আছে সেই থানা সদরে। নৌকায় করে নিতে হবে। নৌকা এক খান নিয়ে সবাই
মিলে বৈঠা বাওয়া শুরু করলো। হাতের তালুতে পানি ঠোলা উঠে গেলো। কারো কোন খেয়াল নেই।
নৌকার গলুইতে বসে ফুফা চোখের পানি ফেলতে লাগলেন নিরবে। তিনিও জানেন না বউ ঘর করতে
চায় না কেন।
এদিকে
বাড়িতে দাদিজানকে ধরে রাখা যায় না। এক মাত্র মেয়ে। তিনি উঠানে ডাঙ্গায় তোলা মাছের
মত তড়পাতে লাগলেন। কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না। ফুফুকে দিন তিনেক বাদে ফিরিয়ে
আনা হলো বাড়িতে। এবার কিন্তু কেউ তার চুল ধরে টানলো না। লাঠির বাড়িতে দাগ বসালো
না পিঠের চামড়ায়। দাদি মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকতেন সারাদিন। ফুফুও শিশুর মত
মাকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো। ফুফুর মুখে চঞ্চল হাসি মুছে গেলো। আষাঢ়ের মেঘলা দিনের
মত গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু একটু করে তার মাথায় সমস্যা দেখা দিতে লাগলো। অনেক
কষ্টে তাকে ঘর থেকে বাইরে আনা গেলেও বাড়ির সীমানার বাইরে নেয়া যেত না। ফুফুর এক
সখি ছিলো। তার নাম সুখি বিবি। সুখি এসে ফুফুকে খবর দিত কোন বনে বইচি পেঁকেছে,
কাদের জাম্বুরা গাছ থেকে জাম্বুরা চুরি করা যায় এইসব। দাদিই এসব
সুখিকে দিয়ে বলাতো। ফুফু শুনে উদাস চোখ মেলে তাকাতো বাড়ির উঠানে।
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন