নির্ঘুম
একটি রাত কেটে গেলো। সারা রাত দুচোখের পারা এক করতে পারিনি। মানুষের চিন্তার বাইরে,
চাওয়ার বাইরেও অনেক কিছু ঘটে যায়। আজ রাতটিও ছিলো সেরকম একটি
রাত। ঠান্ডা বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য মা সন্ধ্যা বেলা এসে জানালা আটকে
দিয়ে গেছেন। জানালার গ্রিল পেরিয়ে কবাটের ওপাশে বাগানের উপর, আমাদের ঘরের ছাদে ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে। নৌকা থেকে আমরা দুজন
ফিরে আসি রাত বারোটার দিকে। আসার পথে দ্বীপ্ত ভাইয়ের মুখ বেশ গম্ভীর ছিলো। পথে
আমার সাথে কোন কথা বললেন না। আমি দুয়েকটা কথা বলার বৃথা
চেষ্টা করলাম। অন্যজনের সাড়া না পেয়ে আমাকে থামতে হলো। খাওয়ার টেবিলেও কোন কথা
বললেন না। আমি তার চোখে চোখ রাখার
চেষ্টা করলাম। কিছুটা মেয়েলিপনা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি
না। আবেগের জোয়ার যেন আমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে অজানা দেশে। দ্বীপ্ত ভাইয়া চোখ সরিয়ে
নিলেন। ভাতের প্লেটের দিকে সেই যে চোখ নামালো। আর একটি বারের জন্য চোখ তুললো না।
খাওয়া শেষ করে সোজা রুমে চলে গেলেন। কি হলো তার!
রাতে
ঘুমাতে গেলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। আমি সাড়া দিয়েই
ঘরে ঢুকলাম। দরজায় খুঁট করে একটু শব্দ
করলাম। কিন্তু তার কোন সাড়া নেই। হালকা করে ডাকলাম, দ্বীপ্ত ভাইয়া।
সে
ডাক শুনলো, হুম, কিছু বলবে?
‘
ঘুমিয়ে গেছেন।
‘
হু!
আমার
হাসি পেলো। ঘুমন্ত মানুষ ডাক শোনে কিভাবে! আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম। মিয়াভাই আর
দ্বীপ্ত ভাইয়ার জন্য আলাদা কম্বল রাখা ছিলো ঘরে। আমি মিয়াভাইয়ের কম্বলটি টেনে
নিলাম। আশা করছিলাম অপর পক্ষ থেকে সাড়া পাবো। কিন্তু কোন সাড়াই পেলাম না। অপেক্ষার
প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। আমি উৎকর্ণ হয়ে আছি। দেয়াল ঘড়ির টিকটিক
শব্দটা পর্যন্ত কানে লাগছে। কেঁপে কেঁপে সেকেন্ডের কাটা এগিয়ে যাচ্ছে। আর সেই সাথে
মহাকালকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মহাপ্রলয়ের দিকে। ঘরের পাশে গাছের পাতা থেকে টুপটাপ
শিশির ঝরার শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। দূরে কোথাও একটা ভুতুম পেঁচার ছানা কেঁদে উঠলো।
আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে। হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে
ধরতে। তার ওই কমলা কোয়া ঠোঁটে আরেকবার ঠোঁট রেখে চুমু খেতে। তার মুখের লোনা স্বাদ
চিনির থেকেও মধুর লাগে। কিন্তু সে নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে। আজকের রাত আলিফ লায়লা ওয়া
লায়লার এক হাজার এক রাতের চেয়ে দীর্ঘ ছিলো। রাতের নির্ঘুম তারারা কখন যে ঘুমিয়ে
পড়তে শুরু করলো আমি টের পেলাম না। পোড়া চোখ দিয়ে কেন পানি গড়িয়ে পড়ে! কার জন্য,
কিসের জন্য এই পানি! আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু আজ আমি
আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি। খোঁয়াড় থেকে বড় ঝুঁটিওয়ালা লাল মোরগটি কোক্করো কো বলে বাগ
দিতে শুরু করেছে। সুবহে সাদিকের সময় হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুললিত
কন্ঠে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। ঘুম হইতে নামাজ উত্তম । বারান্দায় আব্বার গলা খাঁকারির শব্দ শুনলাম। তিনি মসজিদে
যাবেন নামাজ পড়তে।
সকালে
উঠে পড়লাম খুব ভোরে। দ্বীপ্ত ভাইয়ার ওঠার কোন নাম নেই। রাতে যেভাবে কম্বল মুড়ি
দিয়েছিলেন সেভাবেই মুড়ি দিয়ে আছেন। পড়ে পড়ে ঘুমাক। আমার কি! আমি কি তাকে কোন
কিছুতে জোর করেছি নাকি! সে নিজে থেকেই তো এগিয়ে এলো। নাহলে কি আমার এত সাহস কখনো
হত! নাস্তা খেয়ে আমি স্কুলের পথ ধরলাম। স্কুলে পৌঁছে দেখি মাঠে সমাবেশ হচ্ছে। ক্লাস শুরু হলো।
একটা ক্লাসেও মন বসাতে পারছি না। প্রতি ক্লাসে স্যারদের বকা খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে
যাচ্ছি। মেয়েদের বেঞ্চ থেকে সুস্মিতা ডেকে বলল, দোস্ত,
আজ তোর কি হয়েছে?
‘
কিছু হয়নি।
‘
শরীর খারাপ?
‘
না।
‘
মন খারাপ?
‘
না।
‘
প্রেমে পড়েছিস?
আমার
অবাক হয়ে তাকালাম সুস্মিতার দিকে তাকালাম। আমি কি তবে প্রেমে পরেছি। দ্বীপ্ত
ভাইয়ার প্রেমে! এটাকে কি প্রেম বলে? ছেলে ছেলে কি প্রেম সম্ভব?
আমি কি দ্বীপ্ত ভাইয়াকে ভালোবাসি? তবে আমি
এরকম করছি কেন? আমার এমন লাগছে কেন? একটা ছেলেকে চুমু
খেলাম কেন? তার শরীরের গন্ধ পেতে আমি এত উতলা কেন? এটাকেই
কি সমকামিতা বলে? মসজিদের ইমাম সাহেবের মুখ ভেসে এলো
চোখের পাতায়। এক জুম্মাবারে ইমাম সাহেব পবিত্র আল কোরআনের সুরা আল আরাফের তর্জমা
করছিলেন। সুরার ৮০ থেকে ৮১ আয়াতে হযরত লুত (আঃ) এর কওমদের সমকামীতার অপরাধে ধ্বংস
করে দেয়া হয় সেই ইতিহাস বিবৃত আছে। সমকামিতার অপরাধে আল্লাহ
তায়ালা আদ, সামুদ, লুতের
কওমদের ধ্বংস করেন। সোদম ও গোমরা নগরীর লোকদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়
সমকামিতার অপরাধে। জিবরাইল আলাহিস সালামের আঙুলের আঘাতে সেখানে এক সাগর তৈরি
হয়। সেই সাগরের নাম ডেড সি। জর্ডান ইসরাইলের মাঝে মৃত সাগর অবস্থিত। সেখানকার পানিতে লবনের মাত্রা এত বেশী যে কোন উদ্ভিদ বা
জলজ প্রানী বাঁচতে পারে না। আমি কি সেই ধর্ম নিষিদ্ধ পাপের পথে পা বাড়িয়েছি। আমি
সুস্মিতার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
আমার
ভ্যাবাচ্যাকা ভাব দেখে সুস্মিতা তার আসন ছেড়ে উঠে এলো। মুখে ফিঁচেল হাসি। আমাকে
খোঁচাতেই লাগলো। ‘বল দোস্ত, প্লিজ বল। কে সেই সুন্দরী।
কার প্রেমে তুই মজনু হয়েছিস। প্লিজ বল। কানে কানে বল। আমি কাউকে বলবো না। প্রমিজ’।
সুস্মিতার
সাথে আরো কয়েকজন যোগ দিলো। বন্ধুদের ইয়ার্কি ঠাট্টা আজ অসহ্য লাগছে। আমি
টিফিনের আগেই বাড়ি ফিরে এলাম। দ্বীপ্ত ভাইয়ার রুমের
দিকে একবার আড়চোখে তাকালাম। কোন শব্দ নেই। আমার নিজের রুমের দিকে গেলাম। পড়ার
টেবিলে বসলাম। কিছুই ভালো লাগে না। দুই ব্যাটারির একটা রেডিও আছে আমার। ভৈতৃক
সুত্রে পাওয়া বলা যায়। রেডিওটা প্রথমে মিয়াভাইয়ের ছিলো। শহরে যাওয়ার পরে রেডিওটি
আমার মালিকানায় চলে আসে। যদিও প্রতি সন্ধ্যা বিবিসি বাংলার সংবাদ শোনার জন্য
মালিকানা সাময়িক ভাবে আব্বার কাছে হস্তান্তর করতে হয়। সুইচ ঘুরিয়ে চ্যানেল ধরানোর
চেষ্টা করলাম। ঘ্যাড়ঘ্যাড় করছে। বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রে অনুরোধের আসর গানের
ডালি হচ্ছে। উপস্থাপিকা বলে গেলো, আজকের শেষ গানটি
এখন বাজানো হবে। এই গানটির জন্য অনুরোধ করেছেন যশোরের আরবপুর থেকে আতিফ, খুলনার সদর থেকে সৌমিত্র, ডুমুরিয়া থেকে সাকিব এবং আরো অনেকে। এর পরপরই
মিউজিক বেজে উঠলো। রবীন্দ্র সংগীত। ইন্দ্রাণী সেনের কন্ঠে, আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, বসন্তের এই
মাতাল সমীরণে। গতরাতে বসন্ত ছিলো না। কিন্তু ছিলো ফিনিক জ্যোৎস্না । ফুটফুটে চাঁদ।
জোনাকির মেলা। আমার চোখের সামনে আবার সেই দৃশ্যপট ভেসে উঠলো। নদীর শান্ত জলে ভেসে
থাকা এক নৌকা। মৃদুমন্দ দুলছে। পাটাতনে শুয়ে আছে দুটি মানব সন্তান। একে অন্যকে
জড়িয়ে। সমাজ নিষিদ্ধ এক ভালোবাসার টানে। আমার দুচোখে আজ বান নেমেছে। শ্রাবণ ধারার
মত বাঁধ ভাঙা জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমাকে।
মরার
কোকিল নিম গাছে বসে কুহু কুহু করে ডাকা শুরু করছে। বারান্দায় মায়ের সাথে গল্প করছে
ওই পাড়ার মন্ডল বাড়ির মেজ দাদী। মাকে ডেকে বলছে, ‘বড়বৌ, অসময়ে কোকিল পাই ডাহা তো ভালো না। বালা
মুসিবত আসতি পারে । ঢেলা মারে তাড়াই দাও দিন পাইডারে’।
মা
হেসে বললো, ‘কি যে কও না চাচী। পুরোনো দিনের মানষির
মত কথা। পাই ডাকলি বিপদ হবে ক্যান। দ্যাহো পাইডা সাথি খুজে পাতিছে না। তাই ডাকতিছে’।
‘তোমরা যা হতিছো না বউ। মডার্ন
হতি গে সব মানা গোনা ভূলি যাতিছো। ইডা কলাম ঠিক না। কিছু তো মানি গনি চলতি হয়’।
‘চাচী
পান দেবো? পান খাবা?’
‘পান
দিবা। দ্যাও! চাবাই আর কি। খাওয়ার মদ্যি তো এট্টু পান খাই। পানেও আইজকাল ভেজাল।
আগের মত আর স্বোয়াদ নেই। স্বোয়াদ হবে কেমনি। পান গাছের গোড়ায় বস্তা বস্তা সার ঢালে
রাহে চাষীরা। আজকাল চাষীরাও চালাক হয়ে গেছে’।
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন