আমার
নিজের গাড়ী নেই। চাকুরি করে গাড়ি কেনার সামর্থ্য এখনো হয়ে ওঠে নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের
পাঠ চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকেছি বছর দুয়েক। বেতন মোটামুটি ভালই পাই। চলে যায়। দীপ্ত
ভাইয়া বলতেন তোর মাস্টারি করা উচিত। এত বড় বড় চিঠি লিখিস। তোর ধৈর্য্য দেখে অবাক
না হয়ে পারি না। আমার তো এক পাতা লিখতেই কলম ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। সেই স্কুলে
পড়া দিনগুলোয় দীপ্ত ভাইয়াকে প্রতিদিন আমার একটা করে চিঠি লেখা চাই। দ্বীপ্ত ভাইয়া
থাকতেন ঢাকায়। আর আমি থাকতাম সুন্দরবনের খুব কাছের এক নিভৃত গ্রামে। চিঠির
মাধ্যমেই আমি কথা বলতাম দ্বীপ্ত ভাইয়ার সাথে। যখন চিঠি লিখতাম তখন মনে হত দ্বীপ্ত
ভাইয়া আমার সামনেই বসে আছে। আমি তার সাথে মুখোমুখি কথা বলছি। দ্বীপ্ত ভাইয়ার চিঠি
আসলো কিনা জানতে আমি প্রতিদিনই দুই মাইল দূরে পোস্ট অফিসে চলে যেতাম পায়ে হেঁটে
পিয়ন কাকা মজা করে বলত, কি ব্যাপার শুভ্র মিয়া। গ্রামে আর কারো তো এত চিঠি আমি
কারো আসতে দেখিনি এই চাকরি জীবনে। কোন মেয়ে ছেলের নাম ব্যবহার করে চিঠি লেখে নাকি
তোমাকে?
ক্যাবে
ভাইয়া আর ভাবী বসেছে পেছনে আর আমি সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমার কোলে দীপ্ত
ভাইয়ার রাজপুত্র। অক্ষর, দীপ্ত ভাইয়ার ছেলের নাম।
আমার গলা জড়িয়ে ধরে বসে রাজ্যের সব প্রশ্ন করে যাচ্ছে। পদ্মা নদী কতদূরে? জেলেরা
এখন ইলিশ ধরছে কিনা আমেরিকায় বাংলার চর্চা কতটা হয় আমার জানা নেই। তবে অক্ষরের
মুখে বাংলার আধো টানটা আমার কানে বেশ মধুর লাগছে। তার বাংলা উচ্চারণ ঝরঝরে কিন্তু
ভোকাবুলারি অত সমৃদ্ধ নয়। প্রতি সেন্টেন্সে ইংরেজী অক্ষরের ছড়াছড়ি। আমি তার কচি
মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষন। বছর চারেক বয়স হবে অক্ষরের। তার মানে
দ্বীপ্ত ভাইয়া বিয়ের বেশ পরে বাচ্চা নিয়েছেন।
ওপরের
দিকে তাকাতে ভিউ গ্লাসে চোখ পড়ল। ভাবীও ঢাকা শহর দেখায় ব্যস্ত। জানালার কাছে চোখ
নিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন। আর মাঝে মাঝে ভাইয়াকে প্রশ্ন করছেন। “আরে দেখ বনানী বাস
স্ট্যান্ড। অনেকটা আগের মতই আছে না।” অনেক দিন পরে এসেছেন। অনেক কিছুই বদলে গেছে।
তাই চেনা ঢাকাকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করছেন। দীপ্ত ভাইয়ার চোখ ড্রাইভারের উপরের
গ্লাসে। এভাবে কেন তাকাও দীপ্ত ভাইয়া! আর এভাবে তাকিয়ো না। মেঘে মেঘে অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আমরা হয়তো টের পাইনি। এই
ঢাকার মহাসড়কের উপর দিয়ে পার হয়ে গেছে হাজারো মানুষ, হাজারো সব গল্প। আমরা শত চাইলেও ফেলে আসা অতীতে আর ফিরে যেতে পারবো না।
ভাবী বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “ঢাকার অনেক কিছুই চেঞ্জ
হয়ে গেছে। পুরো রাস্তাটাই অচেনা লাগছে। চেনা চেনা লাগে আবার ঠিকে চেনাও যেন নয়। কিন্তু
জ্যামটা চেঞ্জ হলো না। সেই আগের মত রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা। তোমার ফ্লাটে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ
লাগবে শুভ্র।” শীতের এই
সন্ধ্যায় ঢাকার বুকে আজ হালকা উত্তাপ। আমার বুকের উত্তাপ কি আজ বাতাসের শরীরে গিয়ে মিশেছে। ভাবী আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। প্রথম আমি যখন আমি
বললাম, আমাকে তুমি করেই বলেন। সে বললো না সে আপনি করেই বলবে।
‘আর বেশীক্ষণ না। আধাঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাবো। বোরিং
লাগছে খুব? বোরিং লাগার কি আছে । দেশকে সেই চেনা রঙেই উপভোগ
করেন।
‘
বাহ! বেশ কথা বলো তো তুমি। কবিতা লেখো নাকি? আধা ঘন্টা! ভ্যাপসা গরম ভাব
লাগছে। ড্রাইভার এসি টা একটু বাড়িয়ে দাও
ভাই। অনেক দিন পর এলাম তো।
দীপ্ত
ভাইয়া শিস দিতে দিতে বললেন, কণা এত অস্থির হচ্ছো কেন?
হাতে আমাদের অনেক সময়। অনেকদিন এবার দেশে থাকবো আমরা। দেশে
এসেছি। দেশের বাতাস টা একটু উপভোগ করতে দাও। পুরোনো সেই উত্তাপ। পুরাতন সেই আবেগ
একটু চেখে দেখি।
দ্বীপ্ত
ভাই স্বভাব শিল্পী। কথার মাঝের দুচার কলি গান গাওয়া তার পুরাতন অভ্যেষ। গুনগুনিয়ে
একটা সুর ভাঁজা শুরু করলেন, “পুরোনো সেই দিনের কথা
ভূলবি কিরে হায়...”।
হায়!
রবীন্দ্রনাথ, অস্থির কিছু গান লিখে গেছো
তুমি। আমার মনের সব কথা তুমি যেন আগে থেকেই পড়ে রেখেছিলে। আমার সব
কথা খুঁজে পাই তোমার গানে। যখন যে ম্যুডে যে গান
দরকার সবই খুঁজে পাই তোমার ভান্ডারে। পুরোনো দিনের কথা আমি ভূলতে পারিনি কখনো।
পুরোনো দিনের কথা গুলো প্রাণের ব্যাথাগুলো সন্তানের মত লালন করি নিজের মাঝে।
আধা
ঘন্টা নয়। পুরো একঘন্টা পরে বাসায় পৌঁছলাম। ক্যাবওয়ালা ভাড়া নিয়ে কিছু ক্যাচাল
করলো। বাংলাদেশ কখনো কি মিটারে চলতে পারবে! নীতিবোধ কি আইন মানার প্রবণতা দিনদিন
আমাদের মাঝ থেকে কমে যাচ্ছে। আর এত আইন মেনেই বা কি হবে। যস্মিন দেশে যদাচার।
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন