সজল! না, ছেলেটার চোখে কোন জল নেই। তবু তার
নাম সজল আহমেদ। বাবা মায়ের রাখা নাম। আসলে তার নামটি রেখেছিলেন তার আম্মুর
নানা। চোখে তার চাপা দ্যুতি। পৃথিবীটা যে
আনন্দময় তা সজলের চোখ দেখলে বোঝা যায়। সদা হাস্যময় লাস্যময় এক যুবা। অতি সিরিয়াস সময়ে সে রসিকতা করে পরিবেশ হালকা
করার ক্ষমতা রাখে। সজল খুলনার ছেলে। খুলনা টাউনের নয়। মেইন টাউন থেকে বেশ দূরের এক
গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। হলে থাকার
কথা। কিন্তু সে থাকে মিরপুরে।
অনেকক্ষণ শাহবাগে দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটা বাস
পেলো। সিট নাই। সিট আছে, কিন্তু একটাও খালি নাই। পেছনে একটা সিট খালী হলো। কিন্তু
পাশের দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি অতি দ্রুত শূণ্যস্থান পূর্ণ করে ফেলল। লোকটি ছোট খালে
খুব সম্ভবত চেয়ার সিটিং খেলায় এলাকায় চ্যাম্পিয়ন হত। সজল বাসের রড ধরে
দাঁড়িয়ে আছে। কিছুসময় পরে কয়েকব্যক্তির ঘাড় পেরিয়ে একটা ছেলের দিকে চোখ পড়ে গেলো। ছেলেটার
ঠোঁট এবং নাকের গঠন অনন্য। একবার চোখ পড়লে আরেকবার সে ফিরে তাকাবেই। সজলও
দ্বিতীয়বার চোখ তুলল। চোখাচোখি হয়ে গেলো। প্রথম প্রথম অন্য ছেলেদের চোখে চোখ রেখে
তাকাতে সজল লজ্জা বোধ করত। ক্রমে ক্রমে সেটা এখন দূর হয়ে গেছে। এখন সে আর শরমিন্দা
হয় না। সজল হালকা একটা হাসি দিলো। ছেলেটা চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো।
কৈশোরে সুন্দর মেয়েদের দূর থেকে দেখার মাঝে
একটা আলাদা থ্রিল আছে। এ অনেকটা বাগানে ফোঁটা সেরা ফুলটা দেখার মত। ধরা বা ছোঁয়ার
দরকার নেই। দূর থেকে জাস্ট তার সৌন্দর্য্য সুধা উপভোগ করা। তাদের চূড়ির রিনিঝিনি
ঝংকার, কাপড়ের খসখস শব্দ এক অন্যরকম শিরশিরানী এনে দেয় বুকের ভিতর। এটা গেলো আর
দশজন সাধারণ ছেলের কথা। সজলের কিন্তু অন্য কেস। সুদর্শন ছেলে দেখলে তার বুকের ভিতর
শিরশিরে কাঁপন জাগে। দ্বিতীয়বার তাকাবার অদম্য বাসনা তাকে পেয়ে বসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাঠে, ক্যান্টিনে, আমগাছের নিচে যখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়, দূরের কোন সুন্দরী
অপ্সরীকে দেখে সবাই লোভনীয় মন্তব্য করে। সেও তাদের সাথে তাল দেয়। কিন্তু সে মুখ
ফুঁটে বলতে পারে না ঐ অপ্সরীর সাথে থাকা ছেলেটাকে দেখে তার অনুভূতির কথা। এমন এক
সমাজে, এমন এক দেশে জন্মেছে যেখানে সে নিজে থেকেই শিখেছে কোন কোন বিষয় গোপন রাখতে
হবে। কেউ তাকে নিষেধ করেনি। কিন্তু সে জানে যখনি সে মুখ খুলবে তখনই ধর্ম , সমাজ,
পরিবার তার মুখ চেপে ধরবে। সত্যি বলতে কি সজল এখনো জানেনা সে সমকামী কিনা।
কৈশোরে সে প্রথম এর স্বাদ পায় পাশের বাড়ীর
ভাইয়ার কাছে। বাড়ীতে গেস্ট থাকায় সে ঘুমোতে গেছিলো পাশের বাড়ী। ভাইয়া তার থেকে বছর
পাঁচেকের বড় ছিলো। সম্পূর্ণ অচেনা এক জগৎ তার সামনে হাজির হয়। ভালোলাগা মন্দলাগা
তাকে কুরেকুরে খেতে থাকে। পাপবোধে সে কোন কিছুতেই মন বসাতে পারে না। মসজিদে বসে
চুপি চুপি কাঁদে। আল্লাহর কাছে মাফ চায়। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে আদ, সামুদ, লুতের
কওমের মানুষের মত শাস্তি দিয়ো না। আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করো।
সজল সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে কিনা আমি বলতে পারব
না। তবে সে সমকামিতার পথে পুরোপুরি ছেড়ে যেতে পারে নি। আবার ধরেও থাকেনি। আরো
কয়েকবার সে ইচ্ছে অনিচ্ছায় গেছে ভাইয়ার বিছানায়। আর সুন্দর ছেলে দেখলে সে যে
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার মর্ম বুঝতে পেরেছে। এটাকে যে ক্রাশ খাওয়া বলে সেটা
সে জানতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ক্রাশ সে বহুবার খেয়েছে। কারো ফিগার দেখে,
কারো ঠোঁট দেখে, কারো চোখ দেখে কারোবা বাঁকা হাসি দেখে। কাছের বন্ধুরা কেউ কেউ
খেয়াল করে দেখেছে। জিজ্ঞেস করেছে, কি দেখিস। সে মিথ্যা বলেছে। আমি মানুষের হাঁটা
দেখি। খেঁয়াল করে দেখ। একেকটা মানুষের হাঁটার স্টাইল একেকরকম। কেউ দুলে হাঁটে, কেউ
নাচের ছন্দে হাঁটে আবার কেউ পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে হাটে। হাঁটাকে একধরণের শিল্প বলা চলে।
বন্ধু খেয়াল করে দেখে আরে আসলেই তো।
সজল মিরপুর দশে এসে নামে। এক কাপ চা খাওয়া
গেলে মন্দ হবে না। সে মফিজ চাচার দোকানে গেলো। দোকান বলতে রাস্তার ফুটপাতের উপর
কাঠের তৈরী অস্থায়ী দোকান। মফিজ মিয়ার বাড়ী নোয়াখালী। নোয়াখালীর মানুষ সবজায়গায়
পাওয়া যায়। আমেরিকা, লন্ডন, মিডল ইস্ট, এমনকি চাঁদে গেলেও নোয়াখালীর লোক পাওয়া
যাবে বলে আমার বিশ্বাস। মফিজ মিয়ার দোকানে কয়েক আইটেমের চা পাওয়া যায়। লাল চা, দুধ
চা, আদা চা, লেবু চা। মফিজ মিয়া অবশ্য দুধ চা বলে না। বলে সাদা চা। লাল চা যখন আছে তখন সাদা চা ও থাকা
উচিত। আর চায়ের নাম কেন শুধু দুধের নামে হবে। চায়ে তো চিনিও থাকে। কেউ তো কখনো বলে
না চিনি চা। মফিজ চাচার সাদা চায়ের মজাই আলাদা। এক কাপ খেলে আরেক কাপ খেতে মনে
চায়। সজল চায়ের অর্ডার দিয়ে বেঞ্চে বসল। বেঞ্চের চার পায়ার কোন একটা ছোট আছে।
নড়ছে। বসে আরাম পাওয়া যাচ্ছে না। মফিজ মিয়ার পোষা কালো বিড়ালটা মফিজ মিয়ার ছোট
ক্যাশ বাক্সের পাশে বসে আছে। সজলের চোখের দিকে বিড়ালটা তাকিয়ে আছে। একটা মজার কথা কি
জানো বিড়ালের চোখে চোখ রেখে তাকালে সে খুব লজ্জা পায়। সে কিছুতেই তোমার চোখে চোখ
রাখবে না। মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেবে। মানুষ এরকম কুচকুচে কালো বিড়াল কেন পোষে!
কালো বিড়াল নাকি ভূতের বাহন। কয়েকবছর আগে শোনা গিয়েছিলো কালো বিড়ালের মাথায় নাকি
ম্যাগনেট থাকে। মহামূল্যবান সেই ম্যাগনেট নাকি চড়া দামে আমেরিকা কিনে নেয়। মফিজ
চাচা ম্যাগনেটের লোভে কালো বিড়াল পুষেছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে সে শুধু হাসে।
চা শেষ করে সে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলো।
ফুরফুরে বাতাস বইছে। ভালোই লাগছে। বাতাসে শীতের আমেজ। বাতাসটাকে ভালোভাবে উপভোগ
করতে সে ওভারব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালো। বাতাসটা আসছে মিরপুর -১ এর দিকের রাস্তা
ধরে। আজকাল বাতাসেরাও গাড়ীর মত রাস্তা ধরে চলাফেরা করে ঢাকা শহরে। রাস্তার বাইরে
গেলে বড়বড় বিল্ডিং এ বাড়ী খেতে খেতে বাতাসেরা নাকাল হয়ে যায়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
গাড়ীর এই প্যাপু শব্দ কান ঝালাপালা করে দেয়। যান্ত্রিক কোলাহলকে পাশ কাঁটিয়ে সে
বাতাসের শীতলতা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে। বাতাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিলো অন্য
কোথাও। পথচারীর অন্যমনস্ক ধাক্কায় সে সম্বিত ফিরে পেলো। ধাক্কা দেয়া লোকটা মিষ্টি
করে বলে স্যরি। সজল খেয়াল করল সেই ছেলেটা। বাসের ভিতর যাকে দেখে সাময়িক ক্রাশ
খেয়েছিলো। ছেলেটা দেখতে আসলেই অওসাম। ফরসা। মাঝারী হাইট। কানে হেডফোন। ছেলেটা পাশে
দাঁড়িয়েছে। তার দিকে তাকালো। আবার সামনে চোখ ফেরালো। ওভারব্রিজের রেলিং বেয়ে
ছেলেটার হাত সজলের হাত স্পর্ষ করল। সজল পুলকিত হলো। ছেলেটা নিশ্চয়ই তার মত কেউ।
ছেলেটাকে স্মার্ট বলতেই হয়। চোখ দেখেই সে তার মনের কথা পরে ফেলতে পেরেছে। ছেলেটার
চোখ রাডারকে হার মানিয়ে দেবে নিশ্চিত।
ছেলেটা কোন কথা বলছে না। সজলও কোন কথা খুঁজে
পাচ্ছে না। একসময় ছেলেটা কানের পাশে মুখ এনে বলল, ভাই যাবেন? সজল একটু টাশকি খেলো।
সে নিশিকন্যাদের দেখেছে ঢাকা শহরের রাস্তায়। নিশিপুত্রদের কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়
ফেসবুকের পাতায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেগুলো ভূয়া থাকে। কারো সাথে সমস্যা হলে দেখা
যায় একজন আরেকজনের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অমুক টাকা নিয়ে সেক্স করে। তার সাথে
সেক্স করতে চাইলে এই নাম্বারে ফোন দাও ইত্যাদি। এগুলো আসলে অতি জঘন্য
মানসিকতার কাজ। ফেসবুক যারা ব্যবহার করে তারা সবাই মোটামুটি শিক্ষিত। বেশিরভাগ
উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষিত মানুষেরা এই কাজগুলো কিভাবে করে সজল বুঝতে পারে না।
সজল কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কত দিতে
হবে? ছেলেটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, একবার করলে ৫০০ টাকা , দুইবার করলে ৭০০ টাকা।
ব্লোজব নিলে ২০০ টাকা। সজল জিজ্ঞেস করল,
কি করো তুমি? ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, একবার সেক্স করতে কি এগুলা জানা আর্জেন্ট
আপনার?
সজল আর কথা বাড়ালো না। ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে
সামনে এগিয়ে চলল। ছেলেটা এই হ্যালো বলে তাকে ডাক দিলো। সে পেছনে ফিরে তাকালো না।
তার বুকের ভেতরের ভালোলাগাটা এখন বিমর্ষতায় পরিণত হলো। বুকের ভেতর একটা ফাঁকা
অনুভূতি তৈরী হয়েছে। পৃথিবীর আর সব পথ কি ছেলেটার জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে? নাকি সে
টাকা উপার্জনের সব থেকে সহজ পথটাকে বেছে নিয়েছে। খোদা তায়ালা তাকে রূপ দিয়েছে দেহ
ভরে। আর ছেলেটা সেটাকেই পুজি করেছে। সজল তার ফ্লাটের দরজায় পৌঁছে গেছে। রোড লাইটের
আলো পেরিয়ে অনেক দূরের আকাশে তারার মেলা। তারা অবাক চোখে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে।
আচ্ছা সজলের চোখে কি জল থাকা উচিত?
******************** *********************
******************** *********************
******************** *********************
0 টি মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন